শিক্ষা ডেস্ক: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) র্যাগিং নিষিদ্ধ থাকলেও সেখানে এমন কর্মকাণ্ড অব্যাহত ছিল শাসক দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের মাধ্যমেই। জুনিয়র শিক্ষার্থীদের চরমভাবে হেনস্তা করার এই কৌশলটি বরাবরই ব্যবহার করছেন ছাত্রলীগের নেতারা। বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসনে দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষকরা বিষয়টি জানলেও র্যাগিং বন্ধে তেমন কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেননি। বরং তা চলে আসছিল পরম্পরা হিসেবে। বুয়েটে ছাত্রলীগ শাখা কমিটির সিনিয়ররা সব সময়েই এ কাজের আদেশ দিতেন। আর নির্যাতনের শিকার হতেন বরাবরই মধ্যম সারির বা জুনিয়র ব্যাচের কেউ। নির্যাতন করতেন এক ব্যাচ সিনিয়ররা। বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, বুয়েটের বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীর ওপর তুচ্ছ ঘটনা সৃষ্টি করে এবং ইস্যু বানিয়ে নির্যাতন চালাতো ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের না চিনলে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চলে। এজন্য সব সময় জুনিয়রদের ব্যবহার করা হতো। কোনও শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের আগে তার সহপাঠীদের দিয়ে ডেকে আনা হতো। যারা ডেকে আনেন তারা ছাত্রলীগের কর্মী। এরপর এক ব্যাচ সিনিয়রদের দিয়ে ‘অভিযুক্তকে’ মারধর করানো হয়। মারধরকারীরাও ছাত্রলীগের কর্মী। এভাবে চেইন অব কমান্ড অনুসরণ করে নির্যাতন চালানো হয়। জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ছাত্রলীগের পলিটিক্যাল রুম, ছাদ অথবা কোনও খোলা জায়গা। নাম প্রকাশ না করে বুয়েটের আবাসিক শিক্ষার্থীরা এসব তথ্য জানান।
র্যাগিংয়ের নামে এভাবে বছরজুড়েই নির্যাতন চালাতো ছাত্রলীগ। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের নেতারা রুমে বা ছাদে গোল হয়ে বসে কোনও শিক্ষার্থীকে ডেকে নেন। এরপর শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চান—যারা বসে আছেন, সেসব নেতার নাম ও ডিপার্টমেন্ট তিনি জানেন কিনা। বলতে না পারলে তো বটেই, যদি নাম বলতে পারেন কিন্তু ডিপার্ন্টমেন্ট বলতে ভুল হয়, তাহলেও র্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীর কপালে জুটে চড়-থাপ্পড়-লাথি। কেউ একটু অন্যভাবে উত্তর দিলে সেটাকে গুরুতর বেয়াদবি ধরে নিয়ে শুরু হয় ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানোর নামে শিক্ষা দেওয়া। পরম্পরা ঐতিহ্যের মতো ছাত্রলীগের বেপরোয়া দৌরাত্ম্যের শুরুটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা টের পেতে শুরু করেন বুয়েটে ভর্তির পর থেকেই।
স্বপ্নের আবাসিক ক্যাম্পাসটিতে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর শুরু হয় ছাত্রলীগের দাদাগিরি ফলানোর নানা কৌশল। এছাড়া দলীয় সব কর্মসূচিতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করে দেন ছাত্রলীগের নেতারা। তাদের নির্দেশমতো কোনও কর্মসূচিতে যোগ না দিলে ভয় দেখানো হয়, প্রকাশ্যে বা ডেকে নিয়ে মারধর করা হয়। ফলে ভয়ে বা অনিচ্ছায় বেশিরভাগই শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হন। মারধর এড়াতে অনেকেই ছাত্রলীগে নাম লিখিয়ে দলের কর্মী হয়ে যান। আর যারা ভিন্ন মতাদর্শ লালন করেন—তারা নির্যাতনের ভয় এড়িয়ে প্রকাশ্যে সেই দলে যোগ দেন। ফলে অন্য দলের ‘সিলমারা’ কর্মী হওয়ায় রাজনৈতিক রেষারেষি ছাড়া তাদের মার খাওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা কম থাকে। তবে যারা দলাদলি এড়িয়ে নিতান্তই সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে কেবল পড়াশোনাটাই করতে চান, ছাত্রলীগের নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার বেশি হন তারাই। কেউ নিয়মিত নামাজ-রোজা করলে তাকে ‘শিবিরকর্মী’ হিসেবে সন্দেহ করা শুরু হয়, এমনকি সেই শিক্ষার্থীর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য থাকলেও।
বুয়েটের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা আরও জানান, ‘‘কথায় বলে ‘ফার্স্ট ইয়ার, ডোন্ট কেয়ার’, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আসা শিক্ষার্থীরা বয়সজনিত কারণে এমন চটপটে ও চঞ্চল হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, বুয়েটে যারা পড়তে আসেন, তাদেরকে এসেই দেখতে হয় উল্টো নিয়ম। ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সালাম না দিলে, চুল বড় রাখলে, ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে ছুটে না গেলে, সিগারেট না এনে দিলে, কোনও প্রোগ্রামের কাজ না করে দিলে—বিভিন্ন অভিযোগ এনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে নির্যাতন করেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
বুয়েটের হলগুলোতে বছরের পর বছর ধরে র্যাগিংয়ের নামে এ ধরনের নির্যাতন চালিয়ে আসছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ এ অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদ।
তবে বুয়েটের হলগুলোতে র্যাগিং নিষিদ্ধ বলে জানান শেরে বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, ‘বুয়েটের হলে র্যাগিং নিষিদ্ধ। সেটা অনেকদিন আগে থেকেই। এই র্যাগিং প্রতিরোধ করার জন্য প্রত্যেক হলে আমাদের ফোন নম্বর দেওয়া রয়েছে।’
নিষিদ্ধ থাকার পরও হলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন। আর সাধারণ শিক্ষার্থীরা নীরবে এ নির্যাতন সহ্য করে আসছেন। কিন্তু আবরারকে হত্যার পর পুরো ক্যাম্পাস ফুঁসে উঠেছে। একে একে বেরিয়ে আসছে হলগুলোতে র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র।
তিন মাস আগে ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭তম ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থী অভিজিৎ কর। তার অপরাধ—চুল লম্বা রেখেছিলেন তিনি। কেন তার চুল লম্বা, এই অপরাধে আহসানউল্লাহ হলের ছাদে ডেকে নিয়ে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয় তাকে। এই মারধরের ফলে হাত ভেঙে যায় অভিজিতের। হাত ভেঙে দেওয়ার পর এঘটনা কাউকে না বলার জন্য তাকে হুমকি দেওয়া হয়।
অভিজিৎ কর বলেন, ‘হাত ভেঙে যাওয়ার পরও কাউকে বলার মতো অবস্থা ছিল না। কারণ, বাইরের কেউ জানলে আবার মারতে পারে। এই ভয়ে কাউকে বলিনি।’
অভিজিতের বন্ধুরা জানান, ‘তার আর্থিক অবস্থা ভালো না। পরবর্তীতে ১৭তম ব্যাচের বন্ধুরা নিজেরা টাকা সংগ্রহ করে অভিজিতের চিকিৎসা করিয়েছেন।’
শেরে বাংলা হলের আরেক শিক্ষার্থী এহতেশাম। তিনি থাকতেন ২০২ নম্বর রুমে। গত ৩ অক্টোবর বিনা কারণে তাকে মারধরের পর রুম থেকে বের করে দিয়ে রুমটির দখল নেন শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু ও উপ-দফতর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ।
কোন অপরাধে রুম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে তখন তা জানতে পারেননি এহতেশাম। তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে জানতে পারি, আমার নামে বরাদ্দ রুমটি পলিটিক্যাল রুম বানানোর জন্য সেটা তারা দখল নেন। আমি এখন বন্ধুর রুমে আছি।’
সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, বর্তমানে ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে সবচেয়ে সিনিয়র। তবে ১৩ ও ১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে রয়েছেন, তারা সবাই ছাত্রলীগের পদধারী বা সুবিধাভোগী।
বুয়েটের হলগুলোতে সিনিয়রদের নির্দেশে জুনিয়রদের ওপর র্যাগিং কার্যকর করেন ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচের নেতাকর্মীরা। উদাহরণ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলেন, ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের র্যাগ দেন ১৬তম ব্যাচের নেতাকর্মীরা। আর এই র্যাগিংয়ের নির্দেশ আসত ১৩-১৪ বা ১৫তম ব্যাচের সিনিয়রদের কাছ থেকে।
প্রসঙ্গত, গত ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নিয়ে পিঠিয়ে হত্যা করা হয় বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে (২১)। পরদিন ৭ অক্টোবর আবরার হত্যার বিচার দাবিতে আন্দোলনে নামেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
এর আগে ৭ অক্টোবর দুপুরে দেড়টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে আবরারের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ লাশের ময়নাতদন্ত করেন। তিনি বলেন, ‘ছেলেটিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’
৭ অক্টোবর রাতে ছেলেকে হত্যার অভিযোগে চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। মামলায় ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগ। আসামিদের মধ্যে মোট ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৮ অক্টোবর ১০ জনকে আদালতে উপস্থাপন করে রিমান্ড চাওয়া হলে প্রত্যেককে পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।