অনলাইন ডেস্ক: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের অধিকাংশ বন্যপ্রাণীর শুমারি হয়নি দীর্ঘদিন। ফলে বন বিভাগের কাছে বন্যপ্রাণীর প্রজাতি ও সংখ্যার হালনাগাদ কোনো পরিসংখ্যান নেই। বন্যপ্রাণী বাড়ছে, নাকি কমছে, তাও অজানা বন বিভাগের। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার জন্য হালনাগাদ সংখ্যা ও অবস্থা জানা খুবই জরুরি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে নয়নাভিরাম সুন্দরবনের আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বনভূমি চার হাজার ৮৩২ এবং জলাভূমি এক হাজার ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই বনভূমি ও জলাভূমিতে বাস করে ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ ও ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী।
২০১৫ সালের বাঘ শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ ছিল ১০৬টি। আর ২০১৮ সালে করা সর্বশেষ শুমারিতে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। তবে গত বছরের ২০ আগস্ট বনের ছাপড়াখালি এলাকা থেকে বন বিভাগ একটি বাঘের মৃতদেহ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ থেকে ১২ বছর বয়সী বাঘটির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। একই কথা বলা হয় ফরেনসিক প্রতিবেদনেও। গত ৩ ফেব্রুয়ারি বনের কবরখালি এলাকায় মেলে ১৪ বছর বয়সী আরেকটি বাঘের মরদেহ। ওই বাঘটিরও স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে ময়নাতদন্তে। অথচ সুন্দরবনের বাঘ সাধারণত বেঁচে থাকে ১৮ থেকে ২০ বছর। তাহলে কেন বাঘ মরছে- এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক নাজমুস সাদাত সমকালকে বলেন, পূর্ণ বয়সের আগে বাঘ দুটি কেন মারা গেল, তা নিয়ে আরও অনুসন্ধান প্রয়োজন।
বন বিভাগের ১৯৯৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সুন্দরবনের ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খালে ১৫০ থেকে ২০০টি কুমির ছিল। ২০১৭ সালের সবশেষ সমীক্ষায় কুমিরের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ১৫০ থেকে ২০৫টি। কুমিরের সংখ্যা স্থিতিশীল। ওই সমীক্ষায় কুমিরের জন্য সাতটি হুমকি চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে জেলেদের জালে আটকা পড়ে কুমিরের বাচ্চার মৃত্যু; মধু আহরণ মৌসুমে মৌয়ালদের চলাফেরার কারণে ডিমে তা দিতে কুমিরের সমস্যা; বিষ দিয়ে মাছ ধরা; পশুর নদীতে নৌযান ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য দূষণ; পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া; কুমিরের ডিম খেয়ে ফেলে গুইসাপ এবং ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে পুরুষ কুমির।
বেসরকারি সংস্থা ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির জরিপ অনুযায়ী, ২০০৬ সালে সুন্দরবনের নদীগুলোতে ৪৫১টি ইরাবতি ডলফিন এবং ২২৫টি শুশুক ডলফিন ছিল। আর বন বিভাগের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, ইরাবতি ডলফিন আছে ১১৩টি ও শুশুক ডলফিন ১১৮টি। জেলেদের জালে আটকা পড়ে ও নৌযানের প্রপেলারের আঘাতে মারা যাচ্ছে ডলফিন। এ ছাড়া ডলফিন পাচার, অতিরিক্ত মাছ আহরণ, পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিষ দিয়ে মাছ ধরা, পানি দূষণের কারণেও ডলফিনের অস্তিত্ব নিয়ে হুমকি বেড়েছে।বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের হরিণ, বানর, শূকর, উদবিড়াল বা ভোঁদড়ের সবশেষ শুমারি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। ওই শুমারির তথ্য অনুযায়ী, বনে হরিণ ছিল এক থেকে দেড় লাখ; বানর ৪০ থেকে ৫০ হাজার; শূকর ২০ থেকে ২৫ হাজার; উদবিড়াল ২০ থেকে ২৫ হাজার। এর পর আর এই চারটি বন্যপ্রাণীর কোনো শুমারি হয়নি। ফলে বর্তমান সংখ্যা বা অবস্থা বন বিভাগের জানা নেই। এ ছাড়া সুন্দরবনে রয়েছে গুইসাপ, অজগর, কচ্ছপ, পাখি, বনমোরগসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। কিন্তু কখনোই সেগুলোর কোনো শুমারি হয়নি। অধিকাংশ বন্যপ্রাণীর হালনাগাদ সংখ্যা কিংবা বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ ও শূকরের বর্তমান অবস্থা জানা নেই বন বিভাগের। বন্যপ্রাণীগুলো বাড়ছে, নাকি কমছে; তাও অজানা এ সংস্থাটির।
সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের অনেক বন্যপ্রাণীই এখন ভালো নেই। বাঘ শিকার কমলেও থেমে নেই হরিণ শিকার। ইতোপূর্বে বন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে গণ্ডার, বনমহিষ, মিঠা পানির কুমির, এক প্রজাতির হরিণ, চিতা বাঘ ও চার প্রজাতির পাখি। জেলেদের জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে ডলফিন, শুশুক, কুমিরের বাচ্চা ও বিরল প্রজাতির কচ্ছপ। জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানুষের নানা অত্যাচারে কয়েক প্রজাতির প্রাণী এখন সংকটাপন্ন। বনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছ ও কাঁকড়ার ওপর। বিলুপ্ত হতে চলেছে ১৯ প্রকার মাছ।
গত ২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের করমজল, হাড়বাড়িয়া, কটকা, জামতলা, কচিখালি ও ডিমের চর এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, ৪-৫ বছর আগেও এই রুটে নদীর দুই পাশে অসংখ্য হরিণ, বানর, শূকর, গুইসাপ ও পাখি দেখা যেত। আগের তুলনায় সেগুলো এখন কম দেখা যায়। গাছে গাছে আগের মতো আর মৌচাকের দেখা মেলে না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী জানান, জলবায়ু পরিবর্তন ও উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের নদীগুলোতে ক্রমাগত বাড়ছে লবণাক্ততা। এর ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে কুমিরের প্রজননে। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করে রোগাক্রান্ত হচ্ছে বাঘসহ অন্য প্রাণী। লবণাক্ততা সামান্য বাড়লে সুন্দরবনের নদী-খালগুলোতে পারশে, দাতিনা, টেংরা ও ভেটকি মাছ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বন্যপ্রাণীর খাদ্যশৃঙ্খলের কী অবস্থা এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার জন্য সুন্দরবনে কোন প্রাণী কত সংখ্যক রয়েছে, তা জানা খুবই জরুরি। সে জন্য বন বিভাগকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক নাজমুস সাদাত বলেন, সুন্দরবনের সব বন্যপ্রাণীর একটি পূর্ণাঙ্গ শুমারি প্রয়োজন। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর এই শুমারি করতে হবে। সেই সঙ্গে বন্যপ্রাণীর খাবারের কী অবস্থা, তাও জানা জরুরি।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মদিনুল আহসান বলেন, দুটি বাঘের মৃত্যুর কারণ নিয়ে আরও অনুসন্ধান করার পরিকল্পনা রয়েছে। কয়েকটি বন্যপ্রাণীর শুমারি করার জন্য গত জানুয়ারি মাসে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা বন অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সেটি অধিদপ্তরের বিবেচনাধীন। তিনি বলেন, পণ্য ও পর্যটকবাহী জলযান চলাচলের কারণে নদীর দুই তীর থেকে বন্যপ্রাণী বনের ভেতরের দিকে সরে যেতে পারে। সে জন্য হয়তো আগের তুলনায় প্রাণী কম দেখা যায়।
খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মঈনুদ্দিন খান বলেন, বন্য ও জলজ প্রাণী রক্ষায় সুন্দরবনে এখন জিপিএসের সাহায্যে ‘স্মার্ট প্যাট্রোলিং’ চলছে। এ ছাড়া বন্যপ্রাণী রক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে কাজ চলমান।