অনলাইন ডেস্ক : স্বাস্থ্যখাতের বড় পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসক কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকরা।
রোববার ঢাকার একটি হোটেলে সোসাইটি অব সার্জনস অব বাংলাদেশ আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে চিকিৎসক নেতারা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। চিকিৎসকদের বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশিদ আলমও বক্তব্য রাখেন।
কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধ পরিকল্পনা সাজালেও বাংলাদেশে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তা করতে গিয়ে ‘বিজ্ঞানকেও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে সভায় অভিযোগ করেন সরকার সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) নেতা ডা. ইকবাল আর্সলান।
অধ্যাপক ডা. আর্সলান বলেন, রাজনৈতিক নেতারা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে নীতি নির্ধারণ করবেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারা তা বাস্তবায়ন করবেন। এদেশের বিজ্ঞানীরা যে পরামর্শ দিচ্ছেন, সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে তাদের (প্রশাসন ক্যাডার) নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। আমলারা ব্রিটিশ আমলের শাসন ব্যবস্থায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা থেকেই এসব করা হচ্ছে। কোভিড মহামারীর সময় আরেকটা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিএমএর সাবেক এ মহাসচিব বলেন, মহামারীকে উপলক্ষ করে দেশটাকে দখল করার একটা পাঁয়তারা তারা করছেন। এটা আমরা মেনে নিচ্ছি না। এর আগে যখন এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল আমরা তাদের হুঁশিয়ার করেছিলাম। কিন্তু হুঁশিয়ারিটা… আসলে তাদের কানে মনে হয় পানি যাচ্ছে না। যদি কানে পানি দিতে হয় তাহলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অতীতে যেভাবে সব আন্দোলন পরিচালনা করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।”
বিএমএর বর্তমান মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, বিএমএ এবং স্বাচিপের উদ্যোগে সোমবার বিএমএ ভবনে দেশের সিনিয়র চিকিৎসকদের সভা ডাকা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনসহ অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়, প্রতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন জেলার পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। তারপর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের অধীনস্থ একটি পদ হলেও তিনি স্বাস্থ্যের মহাপরিচালককে পাত্তাই দেন না বলে অভিযোগ করেন ডা. এহতেশামুল।
তিনি বলেন, সিএমএসডির পরিচালক পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার সময় চিকিৎসকরা প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সে সময় তাদের কথা শোনা হয়নি। তিনি অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি না সেক্রেটারি আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। তিনি একজন একজন পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন, সুতরাং মহাপরিচালকের সভায় তাকে আসতে হবে। যদি না পোষায় তাহলে চলে যান, কে আসতে বলেছে এখানে? দিস ইস মাই হোম।
স্বাচিপের সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ আজিজ বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে অতিরিক্ত সচিবের পদ ১১৩টি। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে ৬১০ জনকে। এদের পদায়নের জন্যই বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসক কর্মকর্তারা কাজ করছেন। কিন্তু অ্যাডমিনের লোকজন ঢোকানো হচ্ছে। নার্সিং,পরিববার পরিকল্পনায় তাদের লোকজন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনতে পাচ্ছি ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনেও অ্যাডমিনের লোক দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে যেখানে টেকনিক্যাল জনবল লাগে। তারা আমাদের কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেবেন, তা না করে খবরদারি করছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বিএমএর সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের পিঠে আরেকবার ছুরি বসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আপনি জানেন কি না আমি জানি না, নতুন ডিজি হয়ত তার কাজকর্ম এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি আপনাকে বলেছেন কিনা আমরা জানি না। আজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজে চিকিৎসক কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে আমলাতান্ত্রিক করা হচ্ছে।”
এ সময় অনুষ্ঠানে আসা চিকিৎসকরাও টেবিল চাপড়ে, হাততালি দিয়ে চিকিৎসক নেতাদের এসব কথায় সমর্থন জানান।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন ক্ষুব্ধ চিকিৎসকদের আশ্বস্ত করে বলেন, চিকিৎসক স্বার্থহানি হয়, এমন কিছু করা হবে না। পদ-পদবী নিয়ে যে আশঙ্কা করেছেন, তা ভেবে দেখা হবে। এ বিষয়ে আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই সেটা হলো, আমার হাত দিয়ে এমন কোনো কাজ হবে না, যেটা স্বাস্থ্য সেবার বা ডাক্তারদের স্বার্থহানি হবে। আপনারা আমার পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন।”
খুরশীদ আলম স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হলেও তিনি প্রশাসন ক্যাডারের স্বার্থ রক্ষা করছেন বলে চিকিৎসকরা ইঙ্গিত করেন।
ক্ষোভের তীর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের দিকেও এলে আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি বলেন, এই পদে আসার জন্য তিনি কোনো তদবির করেননি।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে বিএমএ মহাসচিব ডা.এহতেশামুল বলেন, “ডিজি মহোদয়, আপনি একজন চিকিৎসক। সবাই বলে আপনি ভালো মানুষ। আমরাও বলি আপনি ভালো মানুষ। আপনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত, রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। তাহলে আপনার পাশে পাক সার জমিন সাদ বাদ কীভাবে ঘোরাফেরা করে? আপনি যতই ভালো মানুষ হোন না কেন, দয়া করে একটু ডান-বাম তাকান।”
তিনি বলেন, “আপনি কতটুকু সৎ, তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়, এটা সরকারের বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু আপনার সভায় আপনার পরিচালক যোগদান করবে না? আপনাকে কথা বলতে হবে। ওই চেয়ার চিরদিনের জন্য নয়। অতীতে একজন ছিলেন, তিনি নেই। আপনিও একদিন থাকবেন না।”
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ প্রশাসন ক্যাডারদের স্বাস্থ্যে নিয়োগ ঠেকাতে চিকিৎসকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, প্রশাসন ক্যাডার চিকিৎসকদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে, সেটা চিকিৎসকদেরই প্রতিহত করতে হবে।
নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর মাস্ক কেলেঙ্কারি, রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তিসহ নানা বিষয়ে সমালোচিত হয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এই পরিস্থিতিতে মহাপরিচালকের পদ ছাড়তে হয় অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাকে। এরপর গত ২৩ জুলাই খুরশীদ আলম নিয়োগ পান।
তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি এই পদে (মহাপরিচালক) কোনো রকমের তদবির করে আসি নাই। এই পদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্বাচন করে আমাকে বসিয়েছেন। আমি এখানে থাকতে আসি নাই। আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে। আমি সেটাই করছি এবং সেটা করেই আমি আমার নির্দিষ্ট সময়ে চলে যাব। কাজেই থাকা, না থাকার বিষয়টিই নেই।”
তিনি বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার জন্য এসেছি। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যতক্ষণ বলবেন ততক্ষণ থাকবো, যখন চলে যেতে বলবেন,তখন আমি চলে যাব।’