নিজস্ব প্রতিনিধি : যখন সারা দেশে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। সংসার চালাতে গিয়ে হাফিয়ে উঠছে সাধারন মানুষ। মিতব্যায়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ঠিক সে সময় জনগনের পকেট কেটে নিজেদের পকেট ভারী করতে মরিয়া সাতক্ষীরার একটি স্বার্থান্বেষী মহল।
আর এর সাথে মেলার অনুমোদন দেয়া কর্তৃপক্ষের বড় অংকের আর্থিক যোগসাজস রয়েছে বলে অভিমত সচেতন মহলের। তা না হলে প্রশাসনের নাকের ডগায় সারাদিন ধরে কিভাবে জেলাব্যাপী মাইকিং করে লটারির টিকিট বিক্রি করা সম্ভব?
অভিযোগ রয়েছে জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, সাংবাদিক ম্যানেজ করেই সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুস সামাদ স্মৃতি সংঘের মাঠে বিজয় মেলা উপলক্ষে চলছে “ওঠাও বাচ্চা” জমজমাট লটারীর আসর। মেলার মুল ফটকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি লাগিয়ে নামমাত্র পুরষ্কার দিয়ে প্রতিদিন লুটপাট করা হচ্ছে প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকা।
প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কালিগঞ্জ, দেবহাটা ও শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকা বিজয় দিবস- ২০২২ উপলক্ষ্যে লোভনীয় পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়ে চলছে লটারীর মাইকিং। লটারীর প্রতিদিনের টিকিট মূল্য ২০ টাকা। অথচ প্রচার ইজিবাইকের পিছনে লেখা আছে প্রবেশের টিকিটের উপর পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠান।
আকর্ষণ হিসেবে ৬১টি পুরষ্কারের মধ্যে প্রথম পুরষ্কার সুজুকী গ্লাক্সীর ১৫৫সিসি মটর সাইকেল, ৩১তম ও শেষ পুরষ্কার হিসেবে একটি করে ৮০ সিসি রানার মটর সাইকেল একজোড়া করে দুজনের সোনার কানের দুল ও ১০টি মোবাইল সেট পুরষ্কার হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। মেলা শুরুর প্রথম আট দিনে একটি লটারী টিকিটের মূল্য ১০ টাকা ও তারপর থেকে লটারী টিকিটের মূল্য ২০ টাকা ধার্য করা হয়েছে।
টিকিট ফেলার জন্য ৭৬টি বক্স ও প্রচারণার জন্য ২৮টি ইজিবাইকের এর ব্যবস্থা করেছেন “ ওঠাও বাচ্চা” লটারীর পরিচালক। কালিগঞ্জ উপজেলার মধ্যে প্রচারনার জন্য একজন ইজিবাইক চালককে দেওয়া হচ্ছে এক হাজার টাকা। উপজেলার বাইরে গেলে দেড় হাজার। এক একজন প্রচারকারি পাচ্ছেন ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা। যারা বিভিন্ন স্থানে বসে টিকিট বিক্রি করছেন তারা প্রতিদিন পাচ্ছেন পাঁশত থেকে সাতশত টাকা। রাত ১০টার পরপরই লটারী শুরুতেই দর্শণার্থী এক বাচ্চাকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে তার চোখে কালো কাপড় বেঁধে চারকোনায় চারজনকে দাঁড় করিয়ে কাপড় টানিয়ে ঢালা হয় বিক্রিত টিকিটের মুড়ি বা ছোট অংশ। এরপর ওই বাচ্চা একএক করে নির্ধারিত পুরষ্কারের আলোকে সেই কয়টি লটারীর টিকিটের মুড়ি অংশ তুলে ধরে সকলের সামনে। পরে ওই লটারীর নাম্বার মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়।
গত ৩০ ডিসেম্বর রাত সাতটায় কালিগঞ্জে এক মাস সাত দিনব্যাপি বিজয় মেলার উদ্বোধন করা হয়। জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর এক মাস সাত দিনের এ মেলার চালানোর অনুমতি দেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নেজারত শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট (এনডিসি) বাপ্পি দত্ত রণি।
৩০ ডিসেম্বর থেকে অনুমোদন পাওয়া মেলায় যাত্রাপালায় নগ্ন নৃত্য, লটারী, জুয়া ও হাউজি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ কালিগঞ্জসহ সাতক্ষীরার ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠণের নেতা, কয়েকজন বড় মাপের জনপ্রতিনিধি কালিগঞ্জের তিনটি সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই প্রতিদিন চলছে মানুষের পকেট ফাকা করার পায়তারা। গত এক সপ্তাহের পুরষ্কারের হিসাবে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকার পুরষ্কার দেওয়া হয়। অথচ প্রতিদিন ২২ থেকে ২৫ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হয়। সেক্ষেত্রে এক মাস সাত দিন মেলা চললে প্রথম ৮ দিনের ১০ টাকা টিকিট ও পরবর্তী একমাসের বিক্রিত টিকিট মূল্য থেকে পুরষ্কার মূল্য, ইজিবাইক, প্রচারকারি, ডেকরেটরসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে মোট ৬০ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে আয়োজক কমিটির।
শ্যামনগর উপজেলার অহিদুজ্জামান পেশায় দ্বীন মজুর। সারা দিন পর উপার্জনের পুরো টাকা দিয়ে প্রতিদিনি ২০ টি টিকিট কিনেছেন। এ পর্যন্ত ১৬ দিনে একটিও পুরষ্কার পাননি। অথচ বাড়িতে চাল ও বাজার না করার প্রতিবাদ করতে যেয়ে স্ত্রী লাকি খাতুনকে পিটিয়ে কোমরের হাড় খেঙে দেওয়া হয়েছে।
ভ্যান চালক আব্দুল কাদের বলেন, প্রতিদিন যে আয় হয় তাতে ১০টি করে টিকিট কেনেন। কিন্তু পুরষ্কারের ভাগ্য খোলেনি তার।
কাঁকশিয়ালী গ্রামের ইমান আলীর ছেলে নজরুল ইসলাম নজু পুরষ্কারের লোভে প্রতিদিন ১০০ থেকে দেড়শত টিকিটি কিনেছেন। বিক্রি করেছেন একটি গাভী ও কয়েকটি হাঁস মুরগি। গত ১৫ দিনে লটারীর পিছনে খরচ করেছেন ৭০ হাজার টাকা। প্রতিবাদ করে লাভ না হওয়ায় শনিবার সকালে স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
লটারী কিনে পুরষ্কারের লোভে পূর্ব নলতার আজগার আলী, কুশুলিয়ার রাজিব, শ্যামনগরের বাধঘাটার রুহুল আমিন, সখীপুরের আবুল বাসারসহ অনেকে এ পর্যন্ত ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার টিকিট কিনেও তাদের কপাল বড় হয়নি।
এ ব্যাপারে কালিগঞ্জ শহীদ আব্দুস সামাদ স্মৃতি সংঘের মাঠে বিজয় মেলা উপলক্ষে লটারীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানিক শিকদার বলেন, লটারী না হলে মেলা চলে না। দেখা করার অনুরোধ জানান তিনি।
মেলার দায়িত্বে থাকা কালিগঞ্জ সড়ক ও পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনি ও সামাদ স্মৃতি সংঘের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ বলেন, মেলা চলছে ঠিকই তবে অনুমোদন বিহীন লটারী চলছে না একথা বলা যাবে না। তবে এটি একটি আনন্দের বিষয় বলে সেখানে যাওয়ার আহবান জানান তারা।
কালিগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোট জানান, মেলায় প্রবেশের টিকিট দিয়ে লটারী করা হয় বলে তিনি জানেন। তবে প্রকাশ্যে লটারী বিক্রির কথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় তাকে অবহিত করলে তিনি বিষয়টি মানিক শিকদারকে ডেকে সতর্ক করেছিলেন। তবে আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠণের কোন নেতা লটারী নিয়ে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন দাবি করে তিনি বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ মামুন রহমান বলেন, অনুমতি ছাড়াই লটারী চলছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রহিমা সুলতানা বুশরা জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। যে কোন সময় লটারী বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এ বাপারে মেলার অনুমতিপত্রে সাক্ষরকারি নেজারত শাখার নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট বাপ্পি দত্ত রণি বলেন, বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।