বিনোদন ডেস্ক : দেশের সুপরিচিত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় টেলিভিশনে প্রথম অভিনয় করেন। তবে নাটকে অভিনয় শুরু তারও আগে। পাকিস্তান রেডিওতে প্রযোজক হিসেবে কাজ করতেন তার মা। মায়ের হাত ধরে যেতে যেতে ৫/৬ বছর বয়সে বেতারে নাটক করেন।
১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত তিনি নিয়মিত শিশু শিল্পী হিসেবে কাজ করতেন যদিও সেটি কেউ মনে রাখেনি, বলেন সুবর্ণা। সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, “আমার সবকিছুই প্রায় একসাথে হয়েছে। টেলিভিশনে নাটক, ঢাকা থিয়েটারে সেলিম আল দ্বীনের নাটক ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুনে অভিনয় আর তার বছরখানেকের মধ্যে ঘুড্ডি চলচ্চিত্রে কাজ।”
তার প্রথম সিনেমা ঘুড্ডি। সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকির ঘুড্ডি চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গে সূবর্ণা বলেন, “কিছুদিন আগে সিনেমাটি দেখলাম। খুব ভালো প্রিন্ট আছে। আমার মনে হলো, ঘুড্ডি যদি জাকি ভাই সাহস করে এখন একবার সিনেপ্লেক্সে রিলিজ করেন আমার মনে হয় লোকজন কিন্তু দেখবে। ছবিটি বোধহয় সময়ের আগে নির্মিত একটি ছবি, অ্যাহেড অব ইটস টাইম। এখন এটি দেখলে দর্শকরা আনন্দ পাবে। সেই পুরনো ঢাকাকে দেখা যাবে।”
কেন ছেড়ে দিলেন মঞ্চ? একটানা ২৫ বছর তিনি কাজ করেছেন মঞ্চে। ঢাকা থিয়েটারে সুবর্ণা মুস্তাফার অভিনীত অনেক চরিত্র এখনো অনেকের মনে দাগ কেটে আছে। সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, ঢাকা থিয়েটারে যারা কাজ করছেন তারা আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমার মেন্টরিং এখানে। আমি থিয়েটার করা শিখেছি নাসিরউদ্দীন ইউসুফের হাত ধরে। কিন্তুএকটা সময় কাজ করতে করতে মনে হচ্ছিল আমার আরেকটু অ্যাডভেঞ্চারাস হওয়া দরকার। আর আমরা একধরনের নাটক করছিলাম – ন্যারেটিভ, সঙ্গীত-নির্ভর। সেলিম আল দ্বীন লিখছিলেন। আমার তো গানের গলা সেইরকম, মানে গান গাইলে ভূমিকম্প হয়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে মনে হলো আর না করি।”
সুবর্ণা বলেন, “অনেক সময় অনেক প্রিয় জিনিস, প্রিয় মানুষের স্মৃতি সুন্দর রাখার জন্য বা সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য দূরে সরে যাওয়া ভালো।”
অনেকে বলেন, অভিমান করে সুবর্ণা মুস্তাফা মঞ্চ ছেড়ে দিয়েছেন। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন “সেসময় অনেক প্রতিষ্ঠিতরা এসেছেন, তারা তখনও গ্রুপের সদস্য। তারা বলেছেন নতুন দল গড়ার কথা। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছি। কারণ আমি ঢাকা থিয়েটারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। যারা কাজ করছেন আমার সাথে তাদের সবার আজ পর্যন্ত দারুণ সম্পর্ক।” মানুষ দুইয়ে দুইয়ে চার দেখতে চায়। কিন্তু সবসময় দুইয়ে দুইয়ে চার হয়না, বলেন তিনি।
কোন মাধ্যম আনন্দ দেয় বেশি? আমার আসলে অভিনয় করেই ভালো লাগে, মাধ্যম যেটাই হোক অভিনয় করেই ভালো লাগে, বলেন সুবর্ণা। “ আনন্দ দিয়েছে সবচে বেশি টেলিভিশন। টেলিভিশনে আমার দীর্ঘ ক্যারিয়ার। ৩/৪ ক্যামেরার সামনে কাজ করেছি। আর কাজ শিখেছি মঞ্চে – চরিত্র কিভাবে নির্মাণ করতে হয়। তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ হলো বেতারে। আর একজন অভিনেতার আল্টিমেট লক্ষ্য হলো সিনেমা-দ্য বিগ স্ক্রিন।”
মঞ্চ-টিভির মত চলচ্চিত্রে ততটা দাপুটে অভিনেত্রী নন – এমন সমালোচনা প্রসঙ্গে সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, যারা বলে তারা মূর্খ। কারণ আমি যে কয়টি বাণিজ্যিক সিনেমা করেছি ৯৫ শতাংশ সুপার-ডুপার হিট। তবে সিনেমায় কাজ করা অনেক কঠিন। এত কষ্ট করতে হয়, আমি আমার বাবা গোলাম মুস্তাফাকে দেখেছি, পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন হুমায়ূণ ফরীদিকে দেখেছি। লম্বা সময় দিতে হয়। কিন্ত আমার নিজের জন্য সময় দরকার।”
সুবর্ণা বলেন, “আমি শর্টকার্টে কোনও কাজ করতে পারিনা। যেটা করবো শতভাগ দিয়ে করবো।” চলচ্চিত্রে শতভাগ দিয়ে কাজ করাটা খুব কঠিন। যারা করেছেন তারা নমস্য, যোগ করেন তিনি।
বিয়ে বিচ্ছেদ ও নতুন সম্পর্ক : সুবর্ণা মুস্তাফার অভিনয়ের শুরুর দিনগুলোতে তাকে ঘিরে সমসমায়িক অভিনেতাদের নিয়ে রোমান্টিক সম্পর্কের গুঞ্জনের খবর বেরুতো পত্রিকার পাতায়। দর্শকদের মধ্যেও বিশেষ করে তাকে আর আফজাল হোসেনকে ঘিরে প্রেমের অনেক গল্প শোনা যেত। রাইসুল ইসলাম আসাদকে ঘিরেও ছিল এমন গুঞ্জন।
সুবর্ণা বলেন “আমি সবসময়ই এটা এনজয় করেছি। তখনও করেছি, এখনও। আমাকে, আফজাল এবং ফরিদী – তিনজনকে ত্রি-রতœ বলা হতো। আফজাল এবং আমার বন্ধুত্ব তো ছিলই। কেন বলবো যে ছিলনা? ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই আমরা একসাথে কাজ করেছি। শুধু টিভিতে আমাদের দেখা হতো, তা না। আমাদের ঢাকা থিয়েটারেও দেখা হতো”।
কিন্তু সেটা কি রোমান্টিক পরিণতির দিকে যাচ্ছিল? এ প্রশ্নের পরিস্কার কোনও জবাব মেলেনি। সুবর্ণা বলেন, “জানি না। আমাদের বয়স তখন ছিল খুবই কম। কাজ করতে গিয়ে প্রেম করতে হবে, এটা কি একটা ব্যাপার? আফজালের সাথে, নূর ভাইর সাথে আমার জনপ্রিয় অনেক নাটক আছে। ফরিদীর সাথে অনেক ভালো কাজ আছে। আফজালের সাথে বন্ধুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে সব বন্ধুত্বই ‘অত:পর তাহারা সুখে শান্তিতে ঘর-সংসার করিতে লাগিল’ তা নাও হতে পারে”।
তবে দর্শকরা যে সুবর্ণা-আফজাল জুটিকে অন্যভাবে দেখতো সেটা তিনিও অনুভব করেছেন। সেটা উপভোগও করতেন। সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, “দর্শক আমাদের একসাথে দেখতে পছন্দ করছে। দর্শক একটা রসায়ন পেয়েছে আমাদের জুটিকে ঘিরে। সিনেমায় যেমন উত্তম-সূচিত্রা, রাজ্জাক-কবরীকে ঘিরে দর্শক এমন ভেবেছে, তেমনি টেলিভিশনে তারা আমাদেরকে এভাবে দেখেছে”।
সুবর্ণা-আফজাল সম্পর্ক বিয়ের পরিণতিতে পৌছায় কিনাএ নিয়ে যখন জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই তেমনই সময় অনেকটা হঠাৎ করেই হুমায়ূন ফরিদী ও সুবর্ণা মুস্তাফা বিয়ে করেন। এরপর দীর্ঘ ২২ বছর তারা সংসার করেন। ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদের খবর সূবর্ণা মুস্তাফা নিজেই মিডিয়াকে জানান। এর পরপরই আলোচনা শুরু হয় তার দ্বিতীয় বিয়ের খবরে।
তবে সুবর্ণা মুস্তাফা মনে করেন, ভক্ত এবং দর্শকরা তার বিচ্ছেদ এবং নতুন বিয়ে নিয়ে খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। দেখিয়েছে মিডিয়ায় তার কাছের লোকজনই। কিন্তু দীর্ঘদিনের বিয়ের বিচ্ছেদ এবং পরে বয়সে ছোট, সিনেমা নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদকে বিয়ে প্রসঙ্গে নিজের সাথে কতটা বোঝাপড়া করতে হয়েছিল সেসময়? এমন প্রশ্নে এই অভিনেত্রী সোজাসাপ্টা জানান, “কোনও বোঝাপড়া করতে হয়নি। কারণ যখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর ফরিদী একসাথে থাকবো না, থাকিনি। যখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর সৌদ বিয়ে করবো, করেছি। এত দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ার বয়স তো অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। আমার ব্যক্তিগত জীবন সবসময়ই ব্যক্তিগত রাখতে পছন্দ করি।” একান্ত ব্যক্তি জীবন নিয়ে অন্যের আগ্রহকে তিনি গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তাই বলেন, “হুমায়ূন ফরিদী আর আমি যখন বিয়ে করেছি তখন তো দর্শকদের অনুরোধে করিনি। তাহলে বিচ্ছেদের সময় দর্শকদের অনুমতি নিতে হবে বা কাউকে স্যরি বলতে হবে কেন?”
আবার দশর্কদের কৌতুহলকেও তিনি সম্মান দেখিয়ে বলেন, “তবে হ্যাঁ একজন পাবলিক ফিগার হিসেবে আমি জানি একধরনের কৌতুহল দর্শকদের থাকবেই। তাই চেষ্টা করেছি সম্পর্কগুলো সম্পর্কে ওপেন থাকতে”। “আমি নিজেই বিচ্ছেদ এবং দ্বিতীয় বিয়ের খবর মিডিয়াকে জানিয়েছি কারণ আমি তো প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে কিছু করছি না। আর দ্বিতীয় বিয়ে যে পৃথিবীতে এই প্রথম ঘটলো তা নয়, আর কণের চেয়ে বরের বয়স কম এটাও প্রথম ঘটনা নয়”।
ব্যক্তি জীবন নিয়ে সামাজিকভাবে অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে সেটা তার কথাতেও উঠে এসেছে। তবে সেসব তার কাছে গুরুত্বপুর্ণ মনে হয়নি। সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, “আমি এসব পাত্তা-টাত্তা দেইনা। আর হুমায়ূন ফরিদীর ডিভোর্সের পর আমাদের বিয়ে হয়েছিল। তখন যদি বিয়ের দু’বছর পর আমাদের বিচ্ছেদ হতো সেটা একটা কথা হতো। ২২ বছর একটি লম্বা সময়। ২২ বছর কোনও ফাজলামি না। ২২ বছর তো অনেকের আয়ুও হয়না। সুতরাং এটা নিয়ে আর কথা বলার কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে যেকোনো বিচ্ছেদই দু:খের অবশ্যই”। শেষপর্যন্ত হুমায়ুণ ফরিদীর সাথে তার দীর্ঘদিনের বিয়েটি টিকলো না কেন সে প্রসঙ্গে তার বক্তব্য ছিল সংক্ষিপ্ত। তবে তিনি বলেন, “পারস্পরিক সম্মান, বন্ধুত্ব বিয়েতে খুব জরুরি। ভালোবাসা কিন্তু থাকে। কিন্তু বন্ধুত্ব আর সম্মানের জায়গাটুকু যদি নড়বড়ে হয়ে যায় তখনই ওই বিয়ের আর কোনও মানে হয়না।” হুমায়ুন ফরিদী যেহেতু বেঁচে নেই তাই তার সম্পর্কে পাবলিক ফোরামে খুব বেশি কিছু বলতে চাননি সুবর্ণা মুস্তাফা।
শুধু বলেন, “এখন হুমায়ূন ফরিদীর কাজ নিয়ে কথা বলতে চাই, ব্যক্তি ফরিদী সম্পর্কে আমি খুব অল্পই বলবো যতটুকু বলতে চাই। কারণ তিনি তো নেই তার স্বপক্ষ সমর্থন করতে বা দ্বিমত প্রকাশ করতে। তাই তাকে নিয়ে কথা বলাটা অশোভন। তার সাথে ২২ বছর ছিলাম একসাথে। আর থাকার মত পরিস্থিতি ছিলনা, তাই ছিলাম না।”
তবে যে বিষয়টি আমাকে ভাবায়, “হুমায়ূন ফরিদীর মত এত বড় মাপের একজন অভিনেতা কেন মারা যাবে এত অল্প বয়সে?
ভবিষ্যত পরিকল্পনা : সুবর্ণা মুস্তাফা অভিনীত এবং তার স্বামী নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদের নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র সেন্সর থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। গ্রাম বাংলার জীবন-প্রকৃতি নিয়ে প্রেম-নির্ভর বাণিজিক্য এই সিনেমাটি দর্শকদের হলে টেনে আনতে পারবে এমনটাই তিনি বিশ্বাস করেন। ভবিষ্যতে তার নিজের চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছা রয়েছে বলেও জানান। জীবনের এত চড়াই-উতড়াই নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই বলে জানান। অভিনয়ের বাইরে তিনি নতুন একটি প্ল্যাটফর্মে কাজ করছেন। ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ থেকে এখন ধারাভাষ্যকার হিসেবে এফএম রেডিওতে কাজ বেশ উপভোগ করছেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।