গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবার রমরমা বাণিজ্যের পাশাপাশি নেশার বাজারে নতুন আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে ‘সিসা’। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, ধানমন্ডিসহ অভিজাত এলাকাসমূহে রীতিমতো ‘সিসা বার’ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। বিত্তবান ঘরের ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে সেসব বারে গিয়ে হাজির হচ্ছে, সিসার ধোঁয়ার নেশায় থাকছে বুঁদ হয়ে। রাজধানীতে গজিয়ে ওঠা শতাধিক সিসা বার নিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারাও বিপাকে পড়েছেন। এটি মাদকের তালিকায় না থাকায় সিসার নেশায় আসক্ত কিংবা তা বেচাকেনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া সিসার বার নিয়ে হাই কোর্টে রিট আছে। সেখানে বলা আছে, ‘সিসার ওপর অভিযান চলতে পারে, যদি এতে মাদকদ্রব্যজাতীয় কিছু মিশ্রিত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এতে যদি কোনো মাদকের অস্তিত্ব না থাকে সে ক্ষেত্রে আমরা আইন প্রয়োগ করতে পারি না। ’ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পরীক্ষায় দেখা গেছে, সিসায় মাদকের উপাদান না পাওয়া গেলেও এটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর মধ্যে উচ্চমাত্রার টক্সি, কার্বন মনো-অক্সাইড হেভি মেটালসহ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান থাকে। টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল হাসিসের নির্যাসের সঙ্গে রাসায়নিক মিশ্রণে সিসা তৈরি হয়। এতে নিকোটিনের পরিমাণও থাকে মাত্রাতিরিক্ত। প্রাচীনকালের হুঁকার ‘নগর সংস্করণ’ই হচ্ছে সিসা। এখন তামাক ও আফিমের সঙ্গে কথিত ফলের নির্যাস মিলিয়ে হুঁকা টানা হয়। অল্প দিনেই সিসা সেবন তরুণ-যুবাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় নেশা হয়ে উঠেছে। গুলশান-বনানীতে মাত্র এক হাজার টাকাতেই যে পরিমাণ সিসা কেনা যায়, তা চার-পাঁচজন মিলে সেবন করতে পারে। ঢাকায় লিমোরা ডিলাইট, পান সালসা, অরেঞ্জ কাউন্টি, ওয়াইল্ড মিন্ট, কিউইসহ বিভিন্ন ফ্লেভারের সিসা পাওয়া যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম সিকদার সাংবাদিকদের বলেন, সিসার বারের জন্য মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কোনো লাইসেন্স লাগে না। সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স থাকলেই সিসার বার গড়ে তোলা যায়। ফলে যে কেউ যেখানে-সেখানে সিসার বার স্থাপনের মাধ্যমে নেশার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। তবে সিসার বারগুলো কেবলই ‘নেশার ধোঁয়া’ সেবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, সেগুলো হয়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশাসহ অসামাজিক কার্যকলাপের আখড়াস্থল। পাশাপাশি সিসার হুঁকায় ইয়াবা ও গাঁজার সংমিশ্রণ ঘটিয়েও নেশাকে তীব্র রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে অহরহ। এসব সিসার বারে কিশোর-কিশোরীদের উদ্বেগজনক ভিড়ও লক্ষ করা গেছে। এ ধরনের সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট সিসার বারগুলোতে অভিযান চালিয়েছে। সেখানে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের সিসার ধোঁয়ায় বুঁদ হয়ে থাকতে দেখে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটও অবাক হয়ে যান। সেসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কিশোর-কিশোরীদের অভিভাবকদের ডেকে নিয়ে ‘সন্তান ভবিষ্যতে আর সিসার বারে যাবে না’ মর্মে মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। গুলশানে ‘…ফুড অ্যান্ড লাউঞ্জ’ নামের সিসার বারের নিচতলা পর্যন্ত পৌঁছেও উপরের তলায় কী হচ্ছে তার কিছুই বোঝার উপায় নেই। ওই সিসা বারের নিচতলায় জুস বার। দ্বিতীয় তলায় ফাস্টফুডের ব্যবস্থা। দোতলা থেকে ছোট ছোট সিঁড়ি দিয়ে উপরে গেলেই আলো-আঁধারির পরিবেশ। চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। চোখ জ্বালাপোড়া করে। মাঝেমধ্যে লাল-নীল আলোর ঝলকানি। টেলিভিশনের বড় পর্দায় হিন্দি চ্যানেলে যৌন-উদ্দীপক গান বাজছে। ছোট ছোট টেবিলে চার, পাঁচ বা ছয়জন করে বসা। বসার জায়গা এত কম যে, একজন বসলে অন্যজনের সঙ্গে গা ঘেঁষে চাপাচাপি করে বসতে হয়। সবার টেবিলে সিসা। সঙ্গে নানা ধরনের কোমল পানীয় রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য ওয়াই-ফাই ফ্রি। আরও ‘অন্তরঙ্গভাবে’ বসার জন্য পৃথক পৃথক কক্ষও আছে। প্রায় অভিন্ন স্টাইলে উত্তরার গলিতে গলিতেও গড়ে উঠেছে সিসার বার। রাত-দিন সেসব আখড়া তরুণ-তরুণীদের অন্য রকম মেলামেশার নিরাপদ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সিসার নামে নেশার জাল বিস্তৃত হচ্ছে রাজধানীজুড়ে। এ জালে আটকা পড়ছে অভিজাত ঘরের সন্তানরা। তরুণ-তরুণীরা সিসা গ্রহণে ঝুঁকে পড়ায় তাদের টার্গেট করে বারগুলোতে সিসার সঙ্গে নানা রকম মাদক মেশানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেশ কিছু দিন সিসার বারে যাতায়াতকারী একাধিক যুবক জানিয়েছেন, টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হলেই সিসার সঙ্গে হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজা, আইস ও যৌন-উত্তেজক ট্যাবলেটের গুঁড়ো মিশিয়ে দেওয়া হয়। সিসার বারগুলোকে আকর্ষণীয় করার জন্য পরিবেশক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে স্বল্পবসনা মেয়েদের। তারা একাকী যাওয়া যুবক-তরুণদের বন্ধুর মতোই সঙ্গ দিয়ে থাকে। বনানীর কামাল আতাতুর্ক সরণি, ১১ নম্বর খেলার মাঠের পাশে, ইউনাইটেড হাসপাতালের পেছনে প্রকাশ্যে ও গোপনে চলছে বেশ কয়েকটি সিসা লাউঞ্জ। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, সাতমসজিদ রোড ও রাইফেলস স্কয়ার-সংলগ্ন অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে গড়ে উঠেছে সিসা লাউঞ্জ। অন্যদিকে খিলক্ষেত ও উত্তরার নামিদামি হোটেল, রেস্টহাউসের সঙ্গেও সিসার বারের সংযুক্তি রয়েছে। সব মিলিয়ে রাজধানীতে নামে-বেনামে শতাধিক সিসা লাউঞ্জ রয়েছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। সিসা সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর বাইরেও। সিসা লাউঞ্জে যাতায়াতকে আধুনিকতার অংশ হিসেবে মনে করে আসক্তরা। রাজধানীর বিভিন্ন সিসা লাউঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, সিসা গ্রহণকারীর মধ্যে বেশির ভাগই স্কুল-কলেজ কিংবা ভার্সিটি পড়ুয়া। তারা কয়েক বন্ধু একত্র হয়ে ডিজে পার্টি বা সিসা পার্টির নামে সিসা উৎসবের আয়োজন করে থাকে।
সূত্র : বিডি প্রতিদিন।