সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষায় শত শত কর্মকর্তা উত্তীর্ণ হতে পারছেন না। এমনকি পরীক্ষার আবেদনপত্রেও ভুল করছেন তারা। এর ফলে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতিও পাচ্ছেন না। বিসিএস ক্যাডারগুলোর কর্মকর্তাদের সিনিয়র স্কেলের পরীক্ষায় বারবার অকৃতকার্য হওয়ার বিষয়টি প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষা বিসিএস ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের চাকরি জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হলেও অনেকেই উত্তীর্ণ হতে পারছেন না। আর এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে চাকরি জীবনে বেতনভাতা বৃদ্ধিসহ সিনিয়র সহকারী সচিব হওয়া যায় না। মেলে না উপসচিব পদে কাক্সিক্ষত পদোন্নতি।
সূত্র জানায়, সিনিয়র স্কেল পদোন্নতি পরীক্ষায় বেশির ভাগ কর্মকর্তা একবারে পাস করতে পারছেন না। আবার অনেকে একাধিকবার পরীক্ষা দিয়ে ফেলের কাতারে থাকছেন। আবার অল্পকিছু কর্মকর্তা পরীক্ষা না দিয়ে চাকরির দীর্ঘ সময় পর চাকরিতে সিনিয়র স্কেল পাওয়ার আশায় থাকেন। তবে তাদের কপালে পদোন্নতি জোটে না। সিনিয়র কর্মকর্তার পরিচয়টুকু সম্বল করে চাকরিতে বহাল থাকেন।
সম্প্রতি এক সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় ২ হাজার ৮৭৭ জন কর্মকর্তা আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে ২৬৯ জন কর্মকর্তার আবেদনপত্রেই ভুলত্রুটি পাওয়া গেছে। তবে বহুবার ফেল করা কিছু কর্মকর্তাকে বিশেষ বিচেনায় পাস করানোর নজির আছে।
সিভিল সার্ভিস ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে চলতি মাসে। এ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য বিভিন্ন ক্যাডার থেকে ২ হাজার ৮৭৭ জন কর্মকর্তা আবেদন করেন। এর মধ্যে ২৬৯ জন কর্মকর্তার আবেদনেই বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে। ফলে ৩১ জুলাই ২০১৭ সালের মধ্যে এসব ভুল সংশোধনের নির্দেশ দেয় সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।
২০১৬ সালের আগস্ট মাসে এ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য আবেদন করেন ২ হাজার ৯৯৬ জন কর্মকর্তা। এর মধ্যে যোগ্য আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯২২ জন। প্রথম পত্রে যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪৯৭ জন। পরীক্ষায় অংশ নেন ১৬৩২ জন। উত্তীর্ণ হন ১৩৭০ জন। এতে অনুপস্থিতি ও অনুত্তীর্ণ কর্মকর্তার সংখ্যা ৪৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিগত বছরে অনুষ্ঠিত অন্যান্য পত্রের পরীক্ষাতেও অনুপস্থিতি ও অনুত্তীর্ণ হার প্রায় একই রকম।
এ প্রসঙ্গে সরকারি কর্ম কমিশনের পরিচালক (সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষা) সেলিমা বেগম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষা প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হয়। বছরে অনুষ্ঠিত দুটি পরীক্ষাতেই একজন কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করতে পারেন। সেলিমা বেগম বলেন, চলতি মাসে এ পরীক্ষায় অংশ নিতে আগ্রহী ২৬৯ কর্মকর্তার আবেদনপত্রেই বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। বিভিন্ন শর্তে এসব আবেদন সংশোধনের জন্য সময় দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভুল সংশোধন না করলে আবেদনপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি পরীক্ষাতেই কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ আবেদন করার পরও অংশ নেন না।
এ মাসে পরীক্ষায় অংশ নিতে আগ্রহী ১৬ কর্মকর্তার আবেদনপত্রের সঙ্গে স্থায়ীকরণের আদেশ না থাকায় ভুল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া আবেদনপত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর ও সিল নেই ৪৩ জনের, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিল আছে স্বাক্ষর নেই ২ জনের, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর আছে সিল নেই ২৮ জনের, প্রার্থী ও ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের স্বাক্ষর ও সিল নেই ২ জনের, প্রার্থী ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর আছে সিল নেই ৩ জনের, প্রার্থীর স্বাক্ষর আছে, সিল নেই ৩২ জনের, মূল আবেদনপত্রের ফটোকপি নেই ১ জনের, স্থায়ীকরণের আদেশ নিজের দ্বারা সত্যায়িত ১ জনের, বিলম্বে জমা দেন ১৪১ জন। উল্লিখিত কারণে ২৬৯ কর্মকর্তার আবেদনপত্রই ভুল হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংশ্লিষ্টরা।
সিনিয়র স্কেলে তিনটি বিষয়ে ৩০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম পত্র- বাংলাদেশ ও চলতি বিষয়াবলি, দ্বিতীয় পত্র- সব সরকারি অফিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন, বিধি ও পদ্ধতি, তৃতীয় পত্র- সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কাজকর্ম সম্পর্কিত বিষয়াদি। একজন কর্মকর্তা এক সঙ্গে তিনটি অথবা কম সংখ্যক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তবে এ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য চাকরির বয়স কমপক্ষে চার বছর ও স্থায়ী হতে হবে। যদি কোনো কর্মকর্তা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারেন তাহলে চাকরির বয়স ১৪ বছর বা নিজের বয়স ৫০ বছর হলে সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সুযোগ দেয় সরকার।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্মসচিব বলেন, সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষায় পাস করার পর কোনো কর্মকর্তা তার সিনিয়র স্কেল পেয়ে থাকেন। এ পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে সিনিয়র স্কেল পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ওই কর্মকর্তা বলেন, ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা নবম গ্রেডে চাকরিতে যোগদান করেন। সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষায় পাস করার পর ষষ্ঠ গ্রেডে বেতন পান।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের এখন বেতন অনেক বেড়েছে। আমাদের সময়ে বেতন-ভাতা অনেক কম ছিল। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে অবসরের সময় আমি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে যে বেতন পেতাম, এখন নতুন চাকরিতে ঢুকেই একজন বিসিএস অফিসার সেই বেতন পাচ্ছেন। স্বচ্ছল জীবন-যাপন করতে পারছেন। কাজেই সাধারণ মানুষকে সঠিক সেবা দেয়ার স্বার্থে কর্মকর্তাদের আরো অনেক পড়াশোনা করা উচিত। সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়া খুবই দুঃখজনক।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে এ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন ২ হাজার ৯৯৬ জন। এর মধ্যে যোগ্য আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯২২ জন। প্রথম পত্রে যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪৯৭ জন। পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৬৩২ জন। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১ হাজার ৩৭০ কর্মকর্তা। ২৬২ জন কর্মকর্তা ফেল করেন। তাছাড়া পরীক্ষায় অংশ নেননি ৮৬৫ কর্মকর্তা। অর্থাৎ ফেল করা ও পরীক্ষা না দেয়া কর্মকর্তার সংখ্যা মিলে দাঁড়ায় ১ হাজার ১২৭ জন।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন ২ হাজার ৭০০ জন। এর মধ্যে যোগ্য আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৪৭ জন। প্রথম পত্রে যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৯ জন। পরীক্ষায় অংশ নেন ৮৪৭ জন। উত্তীর্ণ হন ৭২১ জন। দ্বিতীয় পত্রে যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৪৫ জন। পরীক্ষায় অংশ নেন ১ হাজার ২৬ জন। উত্তীর্ণ হন ৮২৪ জন। তৃতীয় পত্রে যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৩৩ জন। পরীক্ষায় অংশ নেন ৭৯৭ জন। উত্তীর্ণ হন ৭০২ জন।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৭৩ জন ক্যাডার কর্মকর্তাকে সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষায় বিশেষ বিবেচনায় যোগ্য ঘোষণা করে পিএসসি। এর আগেও একাধিকবার বিশেষ বিবেচনায় অনেক কর্মকর্তাকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়।