দেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে সাফল্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশ পুলিশের পদচারণা বাড়ছে। বাংলাদেশি পুলিশের জঙ্গি দমনের অভিজ্ঞতাও জানতে আগ্রহী অনেক দেশ।গত মার্চে ঢাকায় চিফ অব পুলিশ কনফারেন্সের পর আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলও তাদের আঞ্চলিক অফিস ঢাকায় করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে। বৃহত্তম উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) পুলিশের উন্নয়নে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছে। ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম তথা সাইবার ক্রাইম, হিউম্যান ট্রাফিকিং, ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অংশ হিসেবে বর্তমানে ৮টি দেশে পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন। ভারত ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে সমঝোতা স্মারক চুক্তি (এমওইউ) করার কাজ এগিয়ে চলেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাবিশ্বের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা ও পর্যালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘গাললপ পুল’। সংস্থাটির ‘গ্লোবাল ল’ অ্যান্ড অর্ডার রিপোর্ট-২০১৫’ অনুযায়ী, সিঙ্গাপুর ৮৯ পয়েন্ট নিয়ে সারাবিশ্বে প্রথম স্থানে অবস্থান করছে। শ্রীলঙ্কা ৭৯ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ও বাংলাদেশ ৭৮ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। এরপর যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৭, অস্ট্রেলিয়া ৭৭, ফ্রান্স ৭৫ এবং ভারত ৬৭ পয়েন্ট রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের থেকে এগিয়ে আছে।
পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশ বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও জনপদ নয়। কাজেই বৈশ্বিক নিরাপত্তার সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। জঙ্গিবাদ এখন সারাবিশ্বের সমস্যা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। একটি ক্ষুদ্র অংশ দেশে ইসলামের নামে নাশকতা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে বিচ্ছিন্নভাবে দেশি-বিদেশি ও ভিন্ন মতালম্বীদের হত্যা ও মসজিদেও হামলা করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। সেদিক থেকে পুলিশ জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব অর্জন করতে পেরেছে। বাংলাদেশের সেই দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নিতে চায় অনেক দেশ।
বর্তমানে জাতিসংঘ সদর দফতরসহ দারফুর,হাইতি,কঙ্গো,মালি,দক্ষিণ সুদান, লাইবেরিয়া,থাইল্যান্ড ও শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের ৯৬৫ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাত্রা শুরু করে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের ১৭ হাজার ৮৮২ জন সদস্য মিশন সম্পন্ন করেছেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করেছেন ২০ জন পুলিশ সদস্য।
বাহিনীর দক্ষতা উন্নয়নে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার (জাইকা)কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে পুলিশ সদর দফতর। তারা পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার অপপ্রচার ও প্রপাগান্ডা রোধ করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল ও বাংলাদেশ পুলিশের সহযোগিতায় গত ১২-১৪ মার্চে ঢাকার হোটেল সোনারগাঁওয়ে প্রথমবারের মতো জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস এবং আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনে দক্ষিণ এশিয়া ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর পুলিশ প্রধানদের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদসহ আঞ্চলিক যেকোনও বিষয়ে সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করার অঙ্গীকার করা হয়।ওই সম্মেলনে আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ভুটান, ব্রুনাই, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামসহ ১৪টি দেশের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানরা ছাড়াও শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া ইন্টারপোল, ফেসবুক, ইন্টারপোল গ্লোবাল কমপ্লেক্স ফর ইনোভেশন (আইজিসিআই), যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), আসিয়ানাপোল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ট্রেনিং অ্যাসিসট্যান্স প্রোগামসহ (আইসিআইটিএপি) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।
পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ইন্টারপোলের মাধ্যমে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি), সিআইডি, এসবি, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ ও পিবিআই’র কর্মকর্তাদের ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পুলিশ স্টাফ কলেজকে সম্পৃক্ত করার বিষয়েও কাজ চলছে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (কনফিডেন্সিয়াল)মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুলিশের অর্জন এখন অনেক। দিন দিন এর পরিধি বাড়ছে। মালেয়েশিয়ার সঙ্গে অ্যান্টি-টেরোরিজম ও মানবপাচার, প্রবাসী শ্রমিকদের আইনগত সহায়তা প্রদান,মিয়ানমারের সঙ্গে মাদক বিশেষ করে ইয়াবা চোরাচালান ও রোহিঙ্গা ইস্যু এবং বর্ডার এলাকায় পেট্রোল ডিউটি আরও বাড়নোর বিষয়েও দ্বিপাক্ষীয় আলোচনা চলছে।অক্টোবরের মধ্যে তাদের সঙ্গে এমওইউ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে ও এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে শ্রীলঙ্কা, চীন ও ভিয়েতনামসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চলছে। বিদ্রোহী দমনে বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা পুলিশের অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, চীনের সঙ্গে আলোচনাকালে গোয়েন্দা তথ্য, সাইবার ক্রাইম, অর্থনৈতিক ক্রাইম, ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন এবং বিশেষায়িত অপরাধ সম্পর্কে বাংলাদেশের পুলিশ অফিসারদের আরও অধিকতর প্রশিক্ষণ ও কর্মশলার আয়োজন সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্ব পায়। খুব শিগগিরই চীনে একটি আন্তর্জাতিক পুলিশ কনফারেন্সে যোগদান করবো। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সাইবার ও ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমসহ বিভিন্ন বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের লিডারশিপ কোর্সসহ সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কারিগরি সহোযোগিতা প্রদানের বিষয়েও আলোচনা চলছে। তাদের সঙ্গেও এমওইউ করার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। জাতিসংঘের ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমসের (ডিসি) সঙ্গে কাজ চলছে। পুলিশের দক্ষতাসহ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং বাড়াতে জাইকার সঙ্গে কথা হচ্ছে।’
সাইবার অপরাধীরা অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া তরুণদের ৮০ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্ত হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের ওয়ার্কিং রিলেশন তৈরি হয়েছে বলেও জানান মনিরুজ্জামান।