জি.এম আবুল হোসাইন : ঘাড়ে বাগ, বাগের দু’পাশে ঘোলের হাড়ি। গায়ে সাদা রংয়ের গোল গলা গেঞ্জি, পরনে ঘি রংয়ের লুঙ্গি হাটু পর্যন্ত তোলা, পায়ে চটি আর মাথার চুল গুলো পুরোপুরি সাদা। ‘ঘোল নেবে, ঘো ? ১নম্বর ঘোল, কোন ভেজাল নেই, সবাই চেয়ে খায়’ এমন ডাক ছেড়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঝাউডাঙ্গা কাঁচাবাজার পট্টিতে ঘোল বিক্রি করতে দেখা যায় লোকটিকে। ৮৫তে পা রাখা ঘোল বিক্রেতা লোকটির নাম কালীপদ ঘোষ। কলারোয়া উপজেলার কয়লা গ্রামের ঘোষ পাড়ার মৃত. ভূপতি ঘোষের ছেলে কালীপদ ঘোষ। ভিটে বাড়ি মাত্র ৬ শতক। আর মাঠে আছে প্রায় ১ বিঘা ফসলি জমি। বাপ-দাদার এ জাত ব্যবসা মাত্র ১২ বছর বয়সেই জীবনের অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আর সেই থেকেই ছুটে চলা। রোদ বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে প্রতিদিন ভোরে হাড়িতে ঘোল নিয়ে বাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন গ্রামে গ্রামে। ঘোল বিক্রি করেন প্রতি গ্লাস ৫ থেকে ৬ টাকা। দিন শেষে আয় হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। কখনো এর কম, আবার কখনো বেশি। সারাদিন বেচা বিক্রি করে তিনি যখন বাড়ীতে ফেরেন তখন সূর্য অস্থের কোঠায়। কখনো রাতে দু’মুঠো ভাত খেয়ে ক্লান্ত দেহে ঘুম, আবার কখনো না খেয়ে বিছানায় নির্ঘুম গড়াগড়ি, আবার পরদিন পাখি ডাকা ভোরে জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলা। তাঁর গন্তব্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাট-বাজার। ঘোল বিক্রির জন্য কলারোয়া এবং সাতক্ষীরা সদরের কয়েকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন হাটে বাজারে ছুটে চলেন অবিরত। অত্যন্ত পরিশ্রমী সদালাপী কালীপদ ঘোষ ছোট বেলা থেকেই দারিদ্রতার সাথে বসবাস করে আসছেন। জীবন সংগ্রামে খুব বেশি সফলতার মুখ দেখতে না পেলেও স্ত্রী সন্তান নিয়ে খেয়ে পরে সুখী জীবনের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে তিনি এক পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের জনক। দু‘চোখে তাঁর স্বপ্ন ছিল, ছেলেটি লেখাপড়া শিখে তাঁর মুখ উজ্জ্বল করবে, সত্যিকারের মানুষ হবে। কিন্তু অভাবের সংসারে ছেলেকে বেশিদুর পড়াতে না পারলেন না। ছেলে মেয়েরা কে কি করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছেলে অন্যের দোকানে কাজ করে। সে এখন বিয়ে করে আলাদা থাকে। ৩ মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। ছোট মেয়েটা এখনো পড়াশুনা করে। ছোট মেয়েকে পড়াচ্ছি অতি কষ্টে। তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখি। কিসে পড়ে তা জানিনা। তবে শুনেছি ছোট মেয়েটা খুলনা বিএল কলেজে অনার্স পড়ে। তিনি আরো বলেন, আমি নিজে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাইনি। সংসার চালিয়ে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে অনেকটা কষ্ট হলেও কখনো মনোবল হারায়নি। তিনি দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা’কে বলেন, দারিদ্রতার সাথে লড়াইটা জীবনের শুরু থেকেই। গায়ের রক্ত জল করে টাকা পয়সা রোজগার করি, তাতে দুঃখ নেই, মেয়েটা লেখা পড়া করে একটা ভাল চাকরি পেলে হয়তো বা আমার স্বপ্ন পূরণ হবে। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে আরো বলেন, জীবনের ৮৫টা বছর কেটে গেল। অথচ আজো পেলাম না একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড। পেলাম না কোন সহযোগীতা। সরকারের দেয়া ১০টাকা কেজি চাউলের কার্ডও আমার ভাগ্যে জোটেনি। ইতিমধ্যে দুর্গাপুজা শুরু হয়েছে। পুজার কেনাকাটা হয়নি এখনো। কথা গুলো বলতে বলতে অনেক কষ্টে পা বাড়ান সামনের দিকে। আর করুণ সুরে বিড়বিড় করে বলতে থাকেন ‘ঘোল নেবে, ঘোল?