ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, রাষ্ট্রের নির্বাহী ও আইনসভার থেকে বিচার বিভাগের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। তবে সেই ভালো কেমন, সেটা প্রধান বিচারপতি পরিষ্কার করেছেন। তাঁর কথায়, বিচার বিভাগ ডুবুডুবু অবস্থায় নাক উঁচু করে টিকে আছে।
তথ্যটি আমাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আইন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশীদের লেখা পড়ে চোখ ছানাবড়া হলো। তিনি ৭ সেপ্টেম্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে ষোড়শ সংশোধনীর ওপর একটি সমালোচনামূলক মূল্যবান নিবন্ধ লিখেছেন। ‘ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে বিচারকরা রাজনৈতিক বিভেদে, আর সরকার পড়েছে চোরাবালিতে’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি রায়ের রিভিউ হওয়া কেন দরকার, তার সপক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছেন। আর সেটা বলতে গিয়ে তিনি বিচার বিভাগের দুর্নীতির ওপরও আলোকপাত করেছেন। এই লেখায় আমি শুধু দুর্নীতির বিষয়টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই।
বিচারপতি আবদুর রশীদ তাঁর নিবন্ধের ১৩ নম্বর প্যারায় লিখেছেন, ‘বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বাধাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন এবং বিচার বিভাগে দুর্নীতির অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছেন। আর এমনকি সেটা এই মাত্রায় যে, ৯০ ভাগ মামলা ঘুষের মাধ্যমে নিষ্পত্তি ঘটে। অথচ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অদ্যাবধি দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করতেও উদ্যোগী হয়নি।’
এখানে অবশ্য একটি তথ্যগত অসংগতি আছে। ৯০ শতাংশ মামলায় ঘুষের বিষয়টি নির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়নি। এটা ভিয়েতনামের অবস্থা। তবে কোনো প্রাসঙ্গিকতা না থাকলে রায়ে নিশ্চয়ই ভিয়েতনামের উদাহরণ আসত না।
বিচারপতি রশীদের ওই নিবন্ধ পড়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের একজন ইংল্যান্ডপ্রবাসী পাঠক খুব বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি ৩৫ বছর ধরে ইল্যান্ডে থাকেন। এ কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, মিরর পত্রিকায় তিনি পড়েছিলেন যে কর ফাঁকি দিয়ে মদ আমদানির এক মামলায় একজন বিচারক বিচারপ্রার্থীর কাছ থেকে এক বোতল পুরোনো মদ নিয়েছিলেন। পত্রিকাটি তখন লিখেছিল যে সেখানে কোনো বিচারকের ঘুষ গ্রহণের কথা গত দেড় শ বছরে শোনা যায়নি।
প্রথমত, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি বিচার বিভাগের দুর্নীতির প্রতি আলোকপাত করেছেন। বিচারকদের জবাবদিহি-সংক্রান্ত একটি মাইলফলক রায়ে দুর্নীতি নিয়ে আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা আছে, সেটা এই পর্যবেক্ষণ দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। আর এভাবে একজন কর্মরত ও একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের তরফে হয়তো উভয়ের উদ্বেগতাড়িত মনের প্রতিফলন ঘটেছে। আমাদের সঙ্গে সব বিবেকবান মানুষের প্রার্থনা হবে, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে ভিয়েতনামের যে চিত্র এসেছে, তেমন অবস্থা যেন কোনো দেশেরই না হয়।
রায়ের ৭৪৬ পৃষ্ঠায় বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি লিখেছেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন (আইবিএ) সম্প্রতি একটা উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছেন যে ভিয়েতনামে প্রায়শ ঘুষের বিনিময়ে রায় দেওয়া হয়। এটা অনুমেয় যে, শতকরা ৯০ ভাগ মামলা যা আদালত শুনে থাকেন তাতে ঘুষের ব্যাপার রয়েছে। এর সঙ্গে বিচারকেরা ও তাদের ক্লার্ক জড়িত। এবং যেসব মামলায় ঘুষের ব্যাপার থাকে না, বিচারকেরা প্রায়শ কোনো মনোযোগ দেন না এবং কোর্ট স্টাফরাও মামলাসংক্রান্ত কোনো তথ্য দিতে বা আইনজীবীদের নথি দেখতে দিতে অস্বীকৃতি জানান।’ এ বিষয়ে রায়ে এরপর লেখা হয়েছে, ‘রিপোর্ট ছাপা হয়েছে যে ভারতে বিচার বিভাগের দুর্নীতি ক্যানসারে পরিণত হয়েছে এবং তা নিচ থেকে শুরু হয়েছে। এখন ইঞ্চি ইঞ্চি করে ওপরে উঠছে। ২০১০ সালে সাবেক আইনমন্ত্রী শান্তি ভূষণ গত আটজন প্রধান বিচারপতি দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন উল্লেখ করে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে বিচারপতি মারাকান্ডে কাটজু দাবি করেছিলেন উচ্চ আদালতের অর্ধেকটাই দুর্নীতিগ্রস্ত।’
এই মন্তব্যের পরে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি মিলিয়ন ডলার দামি প্রশ্নটি রাখেন: ‘কোশ্চেন ইজ, হোয়াট আওয়ার পজিশন?’
ভিয়েতনামে ৯০ শতাংশ মামলা ঘুষের বিনিময়ে নিষ্পত্তি হয়, ভারতের উচ্চ আদালতের অর্ধেকটা দুর্নীতিগ্রস্ত, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থাটি কী? আমাদের স্মরণকালের ইতিহাসে কোনো রায়ে এই জ্বলন্ত এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সম্ভবত এই প্রথম তোলা হয়েছে।
ওই প্রশ্ন তোলার পরে বিচারপতি হাসান ফয়েজ লিখেছেন, ‘কী উপায়ে বিচারক অপসারণ করা হবে সেটি জনগণ বা বিচারপ্রার্থীর জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। তাঁরা চান তাঁদের মামলা দ্রুত, নিরপেক্ষভাবে ও ন্যায্যতার সঙ্গে এবং কোনো ধরনের অবাঞ্ছিত প্রভাব ছাড়াই নিষ্পত্তি হবে। ঋজু এবং সৎ বিচারক কেবল বিচারপ্রার্থীদের চোখে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি উন্নতির জন্যই নয়; বরং বিচারকদের মধ্যে সততা এবং সৎ গুণের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতেও দরকারি।’
এই পর্যায়ে বিচারপতি যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা আমাদের ২০১০ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের একটি খানা জরিপের ফলাফল প্রকাশের পরে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিক্রিয়া স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। টিআইবি বলেছিল, বিচার বিভাগ হলো ‘সব থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত সার্ভিস সেক্টর’। সুপ্রিম কোর্ট ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব মিয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি বলেছিল, এই জরিপ উপকারী নয়। টিআইবি বলেছিল, এটা দৃষ্টিভঙ্গিগত একটি বিষয়। তবে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি লিখেছেন, ‘বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের মনোভাব কী, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বিচার বিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক সময় অল্পসংখ্যক বিচারকদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
রায় প্রকাশের পরে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রথম বৈঠকে তেমন ‘অল্পসংখ্যক’ বিচারকের বিষয়টির উল্লেখ আমরা দেখতে পাই। কিন্তু যা দেখতে ও জানতে আমরা অপেক্ষায় থাকি, তা হলো জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন।
বিচারপতি আবদুর রশীদ তাঁর নিবন্ধে একই সঙ্গে বিচারপতি এ টি এম আফজাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমানের হতাশার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর লেখায় আছে, ‘ওই দুই সাবেক প্রধান বিচারপতি মনে করেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে কিছুই করা যায় না। কোনো বিতর্কের ভীতি ব্যতিরেকে এখন এটা বলা এবং বোঝার সময় এসেছে যে বিচারকসহ কোনো সাংবিধানিক পদধারীর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যর্থ হয়েছে।’
বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশীদের ওই মন্তব্যের তাৎপর্য গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনার দাবি রাখে। তবে তার প্রেক্ষাপট ও সময়টা কখন কীভাবে, কী প্রক্রিয়ায় হবে, সেটা অগ্রাহ্য করা যাবে না। তবে ‘অল্পসংখ্যক’ যদি আদৌ থেকে থাকেন, তাহলে তাঁদের বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া ব্যতিরেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল জনগণের মনে যথেষ্ট আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ১৯৭৭ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাঁরা সংবিধানে নির্দিষ্ট করা দুটি দায়িত্ব পালন করেননি। একটি কার্যকর আচরণবিধি তৈরি এবং তা পালন করতে বিচারকেরা যাতে বাধ্য হন, সেই পদক্ষেপ তাঁরা নেননি। পাকিস্তান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের তৈরি করা আচরণবিধি ঈষৎ মাজাঘষা করে ১৯৭৭ সালে তারা সেটি গ্রহণ করলেও তা কখনো বিলি করা হয়নি। ২০০০ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের সময় এতে একটা পরিবর্তন আনা হয় এবং তাতে বিধান করা হয় যে প্রধান বিচারপতি চাইলে বিচারকেরা তাঁদের সম্পদ ও দেনার বিবরণী প্রকাশ করবেন। এবারের রায়ের ১৬ দফায় তার অন্তর্ভুক্তি বহাল রয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক মাত্র একবার এটি অনুশীলন করেছিলেন। সেটা অবশ্যই প্রশংসনীয় ছিল। কিন্তু তা ছিল খণ্ডিত এবং ‘ডিজক্লজ’ বা প্রকাশ করার উদ্দেশ্য তাতে পূরণ হয়নি। আমরা পত্রিকান্তরে জেনেছিলাম, বিচারপতি খায়রুল হক ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে তাঁর সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করেছিলেন। এরপরে জানা গিয়েছিল, আপিল বিভাগের আরও চারজন তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা আজ থেকে সাত বছর আগের ওই পর্বটি সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করেও বিস্তারিত জানতে পারিনি। সম্পদের বিবরণী প্রকাশ না করার বিষয়ে বিচারকদের মধ্যে ঐকমত্য সুপ্রতিষ্ঠিত, এর সপক্ষে আমাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই। তাঁরা তাঁদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশে উদ্গ্রীব, তারও প্রমাণ আমরা পাই না।
আমরা আইনের এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নই যে ‘ডিজক্লজ’ মানে প্রধান বিচারপতির কাছে প্রকাশ করা এবং তা শুধুই প্রধান বিচারপতি বা রাষ্ট্রপতি জানবেন, তাহলে তো এর মূল উদ্দেশ্য অর্জিত হলো না। ধারণাটি হলো: ‘আ জাজ শ্যাল ডিজক্লজ হিজ অ্যাসেটস অ্যান্ড লায়াবিলিটিস, ইফ আসকড ফর, বাই দ্য চিফ জাস্টিস।’ এর মানে অবশ্যই এই নয় যে প্রধান বিচারপতি না চাইলে কোনো বিচারক তাঁর সম্পদের বিবরণী সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দিতে পারবেন না।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভূরি ভূরি উদাহরণ আমাদের রায়গুলোতে দেখা যায়। কোনো একটিও উল্লেখযোগ্য রায় সম্ভবত এখনো লেখা হয়নি, যেখানে ভারতের উদাহরণ দেওয়া হয় না। কিন্তু সেই রায়ের লেখকেরা যে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আদালতের ওয়েবসাইটে সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করে চলছেন, সেই আদর্শ কেন আমাদের এখানে অনুসরণ করা হবে না। বিচারক বিচার দিতেই শুধু স্বাধীন তাই নন, তিনি তাঁর সম্পদের বিবরণী প্রকাশেও স্বাধীন। আমরা স্বপ্রণোদিতভাবে সেই স্বাধীনতার অনুশীলন দেখতে চাই।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি প্রশ্ন রেখেছেন, কী সেই ফর্মুলা, যার দ্বারা বিচার বিভাগ আস্থা বাড়াতে পারে?
আমরা মনে করি, শুরুর জন্য সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করা একটি অন্যতম উপায় হতে পারে। মন্ত্রীরা না দিলে বিচারকেরা দেবেন না, এই তর্ক ভেঙে ভারতীয় বিচারকেরা তাঁদের বিবরণী দিচ্ছেন। আমাদের মন্ত্রীদের একটি শিক্ষা দরকার। বিচারকেরা নিজেরা এটা দিলে, তাঁরা একটি পাঠ পেতে পারেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক
সূত্র : প্রথম আলো।