কেএম রেজাউল করিম : পানিফল। যার বহুল অংশ চাষ হয় সাতক্ষীরার দেবহাটায়। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এ ফল সারা দেশে ফল হিসেবে পরিচিতি না থাকলেও দিনে দিনে এর চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। পানি ফলের বাম্পার ফলন ও লাভজনক হওয়ায় আগ্রহ বেড়েছে চাষীদের। হাটবাজার ও ফুটপাত ছাড়াও ক্ষেত থেকে তুলে মহাসড়কের ধারে পানিফল বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের। প্রতি কেজি পানিফল স্থান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ টাকায়। স্থানীয়ভাবে ফলটি উৎপাদন বেশি হওয়ায় জনপ্রিয় চাষ হয়ে উঠেছে। সুস্বাদু ও পুষ্টি গুণসম্পন্ন এ ফলটির চাষ সাতক্ষীরা জেলায় বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে।
ফলচাষ শুরু হয় ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এবং ফল সংগ্রহ করা হয় অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে। পানিফল কচি অবস্থায় লাল, পরে সবুজ এবং পরিপক্ক হলে কালো রং ধারন করে। ফলটির পুরু নরম খোসা ছাড়ালেই পাওয়া যায় হৃৎপিন্ডাকার বা ত্রিভুজাকৃতির নরম সাদা শাসঁ। কাঁচা ফলের নরম শাসঁ খেতে বেশ সুস্বাদু। প্রতি ১০০ গ্রাম পানিফলে ৮৪.৯ গ্রাম পানি, ০.৯ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ২.৫ গ্রাম আমিষ, ০.৯ গ্রাম চর্বি, ১১.৭ গ্রাম শর্করা, ১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮ মিলিগ্রাম লৌহ, ০.১১ মিলি গ্রাম ভিটামিন বি-১, ০.০৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২ ও ১৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। তাছাড়া এ ফলে ৬৫ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি থাকে। পানিফলে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম রয়েছে। দেহের প্রয়োজনীয় খনিজ লবণগুলোর মধ্যে ক্যালসিয়াম অন্যতম। ফসফরাসের সহযোগিতায় শরীরের হাড় ও দাঁতের গঠন এবং মজবুত করা ক্যালসিয়ামের প্রধান কাজ। লৌহ অত্যন্ত জরুরি একটি খনিজ লবন। লৌহের অভাবে মানবদেহে অপুষ্টিজনিত রক্তশূণ্যতা দেখা দেয়। ছোট ছেলেমেয়েরা এবং গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরা অতি সহজে রোগের শিকার হয়। পানি ফলে যথেষ্ট পরিমাণে লৌহ পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম পানি ফলে ভিটামিন ‘সি’ এর পরিমান ১৫ মিলিগ্রাম আর শসাতে আছে ভিটামিন ‘সি’ মাত্র ৫ মিলিগ্রাম । ভিটামিন ‘সি’ শরীরে চামড়া, দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় অপরিহার্য। তাছাড়া ভিটামিন ‘সি’ অস্ত্রে লৌহ শোষণে সাহায্য করে। বাংলাদেশের শতকরা ৯৩ ভাগ পরিবার ভিটামিন ‘সি’ এর অভাবে ভুগছে। খাদ্যে ভিটামিন ‘সি’ এর ঘাটতি বিবেচনা করে এ ফলের প্রতি আমাদের অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পানি ফল কাঁচা খাওয়া হয়, তবে সিদ্ধ করেও খাওয়া যায়। কাঁচা পানিফল বলকারক দুর্বল ও অসুস্থ মানুষের জন্য সহজপাচ্য খাবার। ফলের শুকনো শাঁস রুটি করে খেলে এলার্জি ও হাত-পা ফোলা রোগ উপশম হয়। পিওপ্রদাহ, উদরাময় ও তলপেটের ব্যথ্যা উপশমে পানিফল খাওয়ায় প্রচলন রয়েছে। বিছাপোকা কামড়ের যন্ত্রনায় থেঁতলানো কাঁচা ফলের প্রলেপ দিলে উপকার পাওয়া যায়। পানিফল খুব লাভজনক একটি ফসল। এর উৎপাদন খরচ খুব কম। সাতক্ষীরা জেলার সদর, কলারোয়া, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, আশাশুনি, সদরের আংশিক ও শ্যামনগর উপজেলায় জলাবদ্ধ এলাকার চাষিরা পানিফল চাষ করে অধিক লাভবান হচ্ছেন। ফলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ ফলের চাষ। সেই সাথে বাড়ছে ফলটির জনপ্রিয়তা।
জেলার সিংহাভাগ পানিফল চাষ হয় সাতক্ষীরার দেবহাটায়। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এ ফল সারা দেশে ফল হিসেবে পরিচিতি না থাকলেও দিনে দিনে এর চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। পানি ফলের বাম্পার ফলন ও লাভজনক হওয়ায় আগ্রহ বেড়েছে চাষীদের। পানি ফল বা পানি স্যাংড়া নামের ফল চাষে অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় দেবহাটাসহ সাতক্ষীরা জেলার চাষীরা আগ্রহী হয়ে উঠেছে। স্থানীয়ভাবে ফলটি উৎপাদন বেশি হওয়ায় জনপ্রিয় চাষ হয়ে উঠেছে। সুস্বাদু ও প্রিয় মৌসুমে ফল হিসেবে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলাতে ব্যাপক পরিমান চাষ হচ্ছে। অন্য বছরের তুলনায় দেবহাটাতে ১৪ হেক্টর জমিতে হেক্টর প্রতি ৩২ মেট্রিকটন ফলন হয়েছে। উপজেলার সখিপুর, গাজিরহাট, কামটা, কোঁড়া, দেবহাটা, পারুলিয়া, কুলিয়া, বহেরাসহ বিভিন্ন এলাকায় চাষ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ চাষ ফসল চাষের জমি হিসেবে ডোবা, খানা, মৎস্য ঘেরে সুবিধাজনক। সামান্য লবণাক্ত ও মিষ্টি পানিতে চাষ করা যায়। তাছাড়া পানি ফল গাছ কচুরিপানার মত পানির উপরে ভেসে থাকে, পাতার গোড়া থেকে শিকড়ের মত ডগা বের হয়ে বংশ বিস্তার করে এবং তা থেকে ফল ধারণ করে। পানিফল চাষে খুব বেশি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। সার ও কীটনাশকের পরিমান কম লাগে।
দেবহাটার সখিপুর গ্রামের পানিফল চাষি জিয়াদ আলীর পুত্র আকবর আলী বলেন, এ বছর তিনি একটি ২ বিঘা জমি লিজ নিয়ে পানি ফলের চাষ শুরু করেছেন। শুরুতেই এই চাষ লাভের আশা দেখিয়েছেন তাকে। তিনি আগামী বছর আরও বেশি জমি নিয়ে চাষ করবেন বলেও জানান। আরেক পানিফল চাষি দক্ষিণ সখিপুর গ্রামের মৃত এজাহার আলীর পুত্র ইসমাইল হোসেন ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পানিফল চাষ করে আসছেন। এবছর তিনি ১৫ বিঘা জমিতে এ চাষ করেছেন। তিনি ১৩/১৪ দিন পর পর ফল উত্তোলন করেন। যার বিঘা প্রতি ১২/১৫ মন ফলন পাচ্ছেন। যার প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে পাইকারি বিক্রয় করে লাভবান হচ্ছেন।
সখিপুর ও ডেল্টা মোড় এলাকার খুচরা পানিফল ব্যবসায়ী জামাল উদ্দীন ও আনছার আলী জানায়, বর্তমানে ২০ টাকা দরে পানিফল বিক্রয় করছেন। দিনে গড়ে ২০/৩০ কেজি ফল বিক্রয় করে ১০০/১৫০ টাকা লাভ করে। তাদের এটি মৌশুমী ব্যবসা।
পাইকারি পানিফল ব্যবসায়ী কামটা গ্রামের মৃত আব্দুল ছালেকের পুত্র খোকন বাবু সরদার বলেন, চাষের মৌসুম আসার আগে তিনি অর্ধ শতাধিক চাষীর মাঝে অর্থ বিনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে ফলন আসার পরে বাজার দর অনুযায়ী উৎপাদিত ফসল ক্রয় করেন। এভাবে ২০ বছরের বেশি সময় তিনি পানিফল ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন। প্রতিদিন তিনি ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, বরগুনা, চিটাগাং, সিলেট, রাজশাহী, বেনাপোল, যশোর, নাটোর, বগুড়া, দর্শনা, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ ফল রপ্তানি করেন। বর্তমান জেলার বাইরের বাজার ভেদে পাইকারীভাবে বিক্রি করেন তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার জসীমউদ্দীন বলেন, পানিফল চাষ কৃৃষি খাতে চাষ হিসেবে ধরা না হলেও এটি অতিদ্রুত চাষের খাতে আনা হতে পারে। তাছাড়া গত বছরের তুলনায় এর আবাদ বেড়ে চলেছে। কৃষি অধিদপ্তর থেকে কোন প্রকার বরাদ্দ না থাকলেও রয়েছে চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা। এ অবাঞ্চিত ফলটি দেখতে স্বাদে সুস্বাদু ছোট বড় সব বয়সীদের নিকট জনপ্রিয়, দামেও সস্তা। তাছাড়া একদিকে কম খরচ অন্যদিকে অল্প পরিশ্রমে বেশ লাভবান হওয়ায় চহিদা বেড়েছে পানি ফল চাষিদের।