গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যা করার আগে ওই শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন।
‘প্রিয় বাংলাদেশ’ সম্বোধন করে চিঠি আকারে লেখা ওই স্ট্যাটাসের শেষে ‘যুক্তিবাদী বেয়াদব’ হিসেবে নিজেকে উল্লেখ করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) ভোরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া ওই শিক্ষার্থীর নাম অর্ঘ্য বিশ্বাস। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি খুলনার কাকলিবাগে।
সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, অর্ঘ্য বিশ্বাসের বাবা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা অরবিন্দ বিশ্বাস বলেন, ৬তলায় অবস্থিত বাসার বারান্দা থেকে মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) ভোরে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে তার প্রিয় ছেলে অর্ঘ্য বিশ্বাস।
রাত ২টা ৪৫মিনিটে দেয়া অর্ঘ্য বিশ্বাসের দেওয়া স্ট্যাটাসটি মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। ফেসবুকে অনেকেই শেয়ার দেন এটা। অর্ঘ্য বিশ্বাসের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
প্রিয় বাংলাদেশ,
আশা করি ভালো আছো। তোমার মেরুদণ্ডহীন সিস্টেমের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানলাম। বোকার মতো শিরদাঁড়াটা সোজা রেখে জীবনটা পার করার যে জেদ ছিল সেটা তোমার মেরুদ-হীনতার তন্ত্রে হার মেনে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি থেকে এবং সিজিপিএ’র জন্য পড়াশোনা করে মেধাবী তকমা পাওয়া কিংবা দুর্ঘটনায় বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর পর মিডিয়ার প্রচারের স্বার্থে মেধাবী খেতাব নেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। শুধু শুধু গাধার মতো কোনো ইস্যু পেলে চ্যাঁচিয়ে বার বার তোমার মেরুদণ্ডহীনতা বোঝানো ছাড়া বোধ হয় আমি আর কিছু পারতাম না।
তোমার মেধাবী সূর্য সন্তানদের দেখে আমার বড় আফসোস হয়। দেখ, কীভাবে তারা তাদের মেধাগত যোগ্যতা বলে তোমার সিস্টেমের সাথে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।তারা আমাদের কী বলে জানো? ‘যুক্তিবাদী বেয়াদব’। আমরা ডিপার্মেন্ট-এর বদনাম করি, দল করে সুন্দর সাজানো একটা ডিপার্মেন্টকে নষ্ট করি। সিনিয়র ভাইদের সাথে ঘুরে ঘুরে স্যারদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করি।
কাল সারা রাত অনেক ভাবলাম বুঝলে। সত্যি বলতে কী, আমার এখন মনে হচ্ছে আমরা এই ‘যুক্তিবাদী বেয়াদবেরা’ আসলেই তোমার ক্ষতি করছি। পদ্মা ব্রিজ হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে, আধুনিকায়ন হচ্ছে। সুশাসন এবং আইন ব্যবস্থায় গুম, হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পরও মন্ত্রী মহোদয় সেটা হাতের ময়লার মতো উড়িয়ে দেন। প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। দলীয় এবং নিয়োগ বাণিজ্যের কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা বিশাল সংখ্যক ডিপ্রেসড শিক্ষার্থী তৈরি করছেন। গর্ব করার জন্য বহির্বিশ্বে তোমার বংশদ্ভূত সন্তানেরা রয়েছেন যারা নিজেদের উন্নতির স্বার্থে তোমাকে ত্যাগ করে অন্য দেশকে আপন করে নিয়েছেন।
তোমার মেরুদ-হীন বিদ্বান সূর্য-সন্তানেরা তোমার এত উন্নতি করছে সেখানে আমি তোমার কি উপকার করছি বলো? তোমার টাকায় পড়ে-খেয়ে তোমার সিস্টেমের বিরোধিতা করছি, তোমার সাথে বেঈমানি করছি। দেখে নিও, আর করব না। সেদিন ভিসি স্যার এবং চেয়ারম্যান স্যারের কাছে মাফ চাইনি। আজ তোমার কাছে মাফ চাইছি। তোমার আর কোনো ক্ষতি করব না। আর তোমার বিরোধিতা করব না। সোজা হওয়া এই মেরুদ- ভেঙে নোয়াতে পারব না। সেটা আমার দাঁড়া হবে না। সেজন্য অন্য পথটা বেছে নিলাম।
ভয় পেয়ো না। ধর্মান্ধতায় অন্ধ, ক্ষমতাবলে ভীত, অর্থ মোহে ঘুমন্ত এই বালির নিচে মাথা ঢুকিয়ে থাকা উঠপাখি সদৃশ জাতি কোনোদিনও তোমার ভেঙে পড়ে থাকা মেরুদ- সোজা করার চেষ্টা করে তোমাকে যন্ত্রণা দিবে না। আমার মতো যেসব ‘বেয়াদবেরা’ তোমার সিস্টেম বাগের কারণে ভুল করে জন্মেছে, তারাও আস্তে আস্তে তোমার সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। আশা করি পৃথিবীতে তুমি তোমার উন্নতির ধারা বজায়ে রাখবে।
ভাল থেকো।
ইতি
যুক্তিবাদী বেয়াদব
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ক্লাসে অনুপস্থিত থাকায় বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে ছিটকে পড়েন অর্ঘ্য বিশ্বাস। ফলে এ নিয়ে হতাশায় ছিলেন এবং নিজেকে অপমানিত বোধ করছিলেন অর্ঘ্য বিশ্বাস।
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক মো: আক্কাস আলী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, মোট ক্লাসের শতকরা ৭৫ ভাগ ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হয়। ৭৫ ভাগের নিচে এবং ৬০ ভাগের ওপরে থাকলে জরিমানা দিয়ে পরীক্ষার সুযোগ থাকে। কিন্তু ৬০ ভাগের নিচে ক্লাসে উপস্থিত থাকলে কোনো শিক্ষার্থী চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না। ক্লাসে উপস্থিতির নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়েও কম থাকায় অর্ঘ্য বিশ্বাস।পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। অর্ঘ্য বিশ্বাসের উপস্থিতির হার ছিল ৪২ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের বাইরে তো আমরা কিছু করতে পারি না। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এই নিয়ম প্রযোজ্য। খবর সংবাদমাধ্যমের।
বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, অর্ঘ্যসহ বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ৩ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে হতাশা ও অপমানিত বোধ করছিলেন অর্ঘ্য। এরপর হঠাৎ করেই আত্মহত্যা পথ বেছে নেয় সে।
বাবা অরবিন্দ বিশ্বাস ছেলের ক্লাসে উপস্থিতির হার কম থাকায় চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা জানলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসেন। বিভাগে যোগাযোগ করেন, ছেলের পক্ষ থেকে অনুরোধ করেন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু নিয়ম না থাকায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানানো হয়।
এরপরেও কাজ না হলে অরবিন্দ বিশ্বাস যোগাযোগ করেন তার বন্ধু, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খন্দকার মো: নাসিরুদ্দীনের সঙ্গে তবুও ছেলের পরীক্ষা দেওয়ানোর কোনো সুযোগ পায়নি।