ব্যাপক সংস্কার পরিকল্পনা
* দুর্নীতিবাজ ৬২০ কর্মকর্তার তালিকা
* থানা পর্যায়ে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম
* অনলাইন ও সিসিটিভির নিয়ন্ত্রণে সব অফিস
দুর্নীতি ও মামলা নিয়ে হয়রানিসহ নানা কারণে ইমেজ সংকটে পড়া পুলিশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নানা স্থান থেকে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে সংস্কার পরিকল্পনা করছে পুলিশ সদর দফতর।
দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ প্রশাসন গড়তে ইতিমধ্যে দুর্নীতিবাজ ৬২০ কর্মকর্তার নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। জনবান্ধব ও সেবাবান্ধব পুলিশিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পুলিশ প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কারের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া সদর দফতরের কঠোর নজরদারিতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পোস্টিং আনা হয়েছে। থানা পর্যায়ে যানজট তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপটে সেখানেও ট্রাফিক পুলিশ দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা কার্যকর হলে নিয়োগ-পদোন্নতি-পোস্টিংয়ে অবৈধ অর্থ লেনদেন হবে না। টিএ বিল তুলতেও কনস্টেবলদের কোনো ঘুষ দিতে হবে না। থানা ঘিরে রাজনীতিবিদ, পুলিশ ও প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে। এতে থানার সার্বিক পরিবেশ উন্নত হবে। মামলা নিয়ে কোনো পুলিশ সদস্য কাউকে হয়রানি করতে পারবে না। সারা দেশে দুর্নীতিবাজ ২০ এসপি, ১০০ ওসি এবং ৫০০ এসআইয়ের তালিকা প্রস্তুত করেছে পুলিশ সদর দফতর। বিদ্যমান পাবলিক হেয়ারিং বা ওপেন হাউস ডে কার্যকর করা হবে। পুলিশের সব অফিস থাকবে অনলাইন ও সিসিটিভির নিয়ন্ত্রণে। যাতে এসপি অফিসে বসে ওসিরা কী করছেন তা দেখতে পারেন। একইভাবে এসপি অফিসে কী হচ্ছে ডিআইজি অফিসে বসে তা দেখতে পারবেন। আবার ডিআইজি অফিসে কী হচ্ছে তা পুলিশ সদর দফতরে বসে দেখতে পারবেন পুলিশপ্রধান। সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে কার্য সম্পাদন করার জন্য সাতজন কর্মকর্তার জন্য একজন করে কমান্ডিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হবে। এসব ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতর থেকে কিছু নির্দেশনা শিগগিরই সারা দেশের রেঞ্জ ডিআইজি ও এসপিদের কাছে পাঠানো হবে।
আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বুধবার দুপুরে বলেন, ‘আমি আইজিপি হিসেবে যোগ দিয়ে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলাম, কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না। কেউ অপরাধ করলে তাকে অপরাধী হিসেবেই দেখা হবে। সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। সদর দফতরের বিভিন্ন উইং প্রধানকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের নির্দেশ দিয়েছি।’ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করুন। আমি কোনো হস্তক্ষেপ করব না। কিন্তু কেউ যদি নিজের কাজ ভালোভাবে না করেন তবে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করব।’ আইজিপি আরও বলেন, ‘পুলিশের সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিভিন্ন ইউনিট এ নিয়ে কাজ করছে। পুলিশের যেসব সমস্যা আছে সেসব চিহ্নিত করা হচ্ছে। এরপর কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, পুলিশ প্রশাসনে সংস্কারের অংশ হিসেবে সাতজন কর্মকর্তার জন্য একজন করে কমান্ডিং অফিসার নিয়োগের চিন্তাভাবনা চলছে। একজন এসপি সর্বোচ্চ সাতজন অতিরিক্ত এসপিকে কমান্ড দিতে পারবেন। একইভাবে একজন ডিআইজি সর্বোচ্চ সাতজন অতিরিক্ত ডিআইজিকে কমান্ড দিতে পারবেন। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, থানাগুলোতে পুলিশ, রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীদের একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। ওই সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে। পাশাপাশি রাজধানীসহ সারা দেশের থানাগুলোর পরিবেশ উন্নত করা হবে। যাতে মানুষ থানায় গিয়ে স্বস্তিবোধ করে।
সূত্র জানায়, থানাগুলোতে সাধারণত প্রতিদিন ৭-৮টি টহল দল কাজ করে। কিন্তু থানায় দুই বা তিনটির বেশি টহল গাড়ি নেই। এ ক্ষেত্রে ৫-৬টি গাড়ি ভাড়া বা রিকুইজিশন করতে হয়। জানা গেছে, পুলিশের যে কর্মকর্তা গাড়ি ভাড়া বা রিকুইজিশন করেন ওই কর্মকর্তাকেই গাড়ির তেল থেকে শুরু করে সব খরচ বহন করতে হয়। এখন প্রশ্ন হল- ওই কর্মকর্তা ওই টাকা পান কোথায়? তাই পুলিশ সদর দফতর পরিকল্পনা করছে, যাতে কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে সরকারি কাজে ব্যক্তিগতভাবে গাড়ি ভাড়া করতে না হয়।
সূত্র জানায়, আমলযোগ্য অপরাধে মামলা করতে কেউ থানায় এলে ওসি সেই মামলা নিতে বাধ্য। কিন্তু অনেক সময় সাধারণ মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়। শুধু মামলা করা নয়, তদন্তের আপডেট জানতে ও চার্জশিট দেয়া পর্যন্ত মানুষকে হয়রানি করা হয়। এসব হয়রানি দূর করতে ডিজিটাল মামলার কথা ভাবা হচ্ছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি (ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স) মনিরুজ্জামান বলেন, সারা দেশে থানাগুলোতে ব্যাপক সংস্কার আনার চিন্তাভাবনা চলছে। জনবান্ধব ও সেবাবান্ধব পুলিশিং চালু করতে পুলিশ সদর দফতর থেকে অতীতে নানা ধরনের নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এগুলো যাতে যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হয় সে বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর এখন কঠোর অবস্থানে আছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কতিপয় দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই দুর্নীতি বন্ধ হবে না। এর জন্য সিস্টেমের পরিবর্তন করতে হবে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস জানান, পুলিশের সংস্কারের জন্য মাঠ পর্যায়ে অনেক গণমুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শিগগিরই আরও কিছু নির্দেশনা দেয়া হবে।
পুলিশের এ সংস্কার উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সার্বিক বিষয়ে পুলিশের সংস্কার হওয়া উচিত। যারা বিধিমালা লংঘন করবে, অনৈতিক কাজে জড়াবে, অবৈধ লেনদেনে যুক্ত হবে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সুশাসন মানেই আইনের শাসন। পুলিশের পক্ষ থেকে যেসব সংস্কার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেগুলো কার্যকর হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
সূত্র: যুগান্তর