দেশের খবর: মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল যে ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে সেটি প্রায় ৩৩২ কোটি টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে সরকার। পুরান ঢাকার হৃষিকেশ রোডের এই ভবনটি এত দিন ব্যক্তিমালিকাধীন পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত ছিল।
বুধবার সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ সংক্রান্ত একটি ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদন করা হয়েছে।
কমিটির সভাপতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে কমিটির সদস্য, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণলয়ের সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন’ অনুসারে সরকার ‘সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে’ বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে রোজ গার্ডেন কিনবে। এতে ব্যয় হবে ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ দুই হাজার ৯০০ টাকা।
জানা গেছে, পুরনো ঢাকার হৃষিকেশ দাস লেনে বলধা গার্ডেনের সামান্য দূরত্বে ১৯৩১ সালে নির্মিত হয়েছিল প্রাসাদসম ভবন রোজ গার্ডেন। এ বাড়িতে ১৯৪৯ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রথমে দলটির নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পরবর্তীকালে, ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নাম রাখা হয়: ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। পরবর্তী কালে এর নাম ছিল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এই সংগঠনটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
১৯৩১ সালে ঋষিকেশ দাস নামে এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পুরান ঢাকার ঋষিকেশ রোডে ২২ বিঘা জমির ওপর একটি বাগানবাড়ি তৈরি করেন। বাগনে প্রচুর গোলাপ গাছ থাকায় এর নাম হয় রোজ গার্ডেন। এছাড়া বাগানটি সুদৃশ্য ফোয়ারা, পাথরের মূর্তি দ্বারা সজ্জিত ছিল। মূল ভবনের দ্বিতীয়তলায় পাঁচটি কামরা আর একটি বড় নাচঘর আছে। নিচতলায় আছে আটটি কামরা।
ভবনটির মোট আয়তন সাত হাজার বর্গফুট। উচ্চতায় ৪৫ ফুট। ছয়টি সুদৃঢ় থামের ওপর এই প্রাসাদটি স্থাপিত। প্রতিটি থামে লতাপাতার কারুকাজ করা। প্রাসাদটির স্থাপত্যে করিন্থীয়-গ্রিকশৈলী অনুসরণ করা হয়েছে।
ভবন নির্মাণের কিছুদিন পর ঋষিকেশ দাশ দেউলিয় হয়ে যান। ১৯৩৭ সালে রোজ গার্ডেন বিক্রি হয়ে যায় খান বাহাদুর আবদুর রশীদের কাছে। এর নতুন নামকরণ হয় ‘রশীদ মঞ্জিল’।
এই বাড়িটিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) গঠনের প্রাথমিক আলোচনা সভা এই বাড়িতে হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে কাজী হুমায়ুন বসির এর মালিকানা লাভ করেন।
১৯৭০ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল স্টুডিও’ কে লিজ দেয়া হয়। এ সময়ে চলচ্চিত্রের শুটিং স্পট হিসেবে এই ভবনটি ব্যবহৃত হয়। এখানে চিত্রায়িত কাহিনী চিত্র ’হারান দিন’ এ রোজ গার্ডেনের সেই সময়কার চিত্র সংরক্ষিত আছে। ১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই প্রাসাদটি সংরক্ষণ তালিকাভুক্ত করে।
১৯৯৩ সালে কাজী হুমায়ুন বসিরের বংশধর কাজী রকীব বাড়িটির মালিকানা ফেরত পান। ১৯৯৫ সালে তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী লায়লা রকীব ওই সম্পত্তির মালিক হন।
রোজ গার্ডেন নামের এই রাজকীয় বাড়িটি নির্মাণের পেছনেও রয়েছে বঞ্চনা আর অপমানের ইতিহাস। বলধার জমিদারখ্যাত নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী বলধায় একটিবাগানবাড়ি নির্মাণ করেন। যা বর্তমানে বলধা গার্ডেন নামে পরিচিত। এখানে নিয়মিত গানের আসর বসতো। সেই সময়কালে পূর্ববঙ্গের উচ্চবিত্তদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয় এটি। জমিদার ও নাট্যকার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর এক অনুষ্ঠানে বিনা আমন্ত্রণে হৃষিকেশ দাস নামের ঢাকার এক ধনী ব্যবসায়ী বলধার এক অনুষ্ঠানে যান। কিন্তু ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হলেও সনাতন ধর্ম জাতবিন্যাস অনুযায়ী নিম্ন বর্ণের হওয়ায় সে অনুষ্ঠানে তাকে অপদস্থ করা হয়।
এভাবে অপমান তীব্র ভাবে ঝড় তোলে ব্যবসায়ী হৃষিকেশের মনে। একই রকম বাগানবাড়ি নির্মাণ করে প্রতিশোধ নিতে দৃঢ প্রতিজ্ঞ হন তিনি। এরই ফলশ্রুতিতে নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর বাগানবাড়ির আদলে তিনি নির্মাণ করেন রোজ গার্ডেন।
কিন্তু ধনী ব্যবসায়ী হৃষিকেশ একপর্যায়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। অপমানের প্রতিশোধ নিতে তৈরি করা সেই বাড়িটিই আত্মসম্মান বাঁচাতে ১৯৩৬ সালে বিক্রি দেন তিনি। কিনে নেন ঢাকার আরেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খান বাহাদুর মৌলভী কাজী আবদুর রশীদ।