অনলাইন ডেস্ক: বিমসটেকের মাধ্যমে জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মুক্তবাণিজ্য এলাকা সৃষ্টি, বিনিয়োগ ও জ্বালানি সহযোগিতা, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং অর্থায়ন প্রক্রিয়ার উন্নয়নে সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার (৩০ আগস্ট) স্থানীয় সময় বিকেলে নেপালের কাঠমান্ডুতে হোটেল সোয়ালটি ক্রাউনি প্লাজায় চতুর্থ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতকালে তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ভুটানের অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দাসো শেরিং ওয়াংচুক, শ্রীলংকান প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রিয়ুথ চ্যান-ও-চার, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট (নাম জানি না) বিমসটেক সম্মেলনের উদ্বোধনী সেশনে উপস্থিত ছিলেন।
চতুর্থ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সভাপতি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির সভাপতিত্বে উদ্বোধনী সেশন অনুষ্ঠিত হয়। নেপালের জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সম্মেলন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি।
বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাত দেশের জোট বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন)। প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে এ জোট গঠিত হয়। ১৯৯৭ সালে ব্যাংকক ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড বিমসটেকের সূচনা হয়। পরে মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান বিমসটেকে যোগ দেয়।
এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ‘শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও টেকসই বে অব বেঙ্গল অঞ্চল গড়ার পথে’।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন গতিশীলতার ফলে বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। এক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ দেশগুলোকে নতুন গতিশীলতার সঙ্গে তাল মেলাতে হবে এবং বর্তমান বাস্তবতা হলো দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয়- এই ত্রিমুখী সহযোগিতার মাধ্যমে এটা করতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিমসটেকের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং ঢাকায় বিমসটেক সচিবালয় – আঞ্চলিক ফোরামের প্রতি পূর্ণ অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ।
বিমসটেককে বিশ্বের প্রগতিশীল অঞ্চলের জোট হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ অঞ্চলে আন্তঃবাণিজ্য সম্প্রসারণের বিশাল সুযোগ রয়েছে এবং দেশগুলোর উচিত এই সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা।
শেখ হাসিনা বলেন, নেতাদের খুব উৎসাহী সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠার ২১ বছরে বিমসটেকের সফলতা হাতে গোনা কয়েকটি।
এ প্রেক্ষিতে তিনি বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিমসটেকের সুযোগ ও কাঠামো পুনঃপর্যালোচনা করতে উপস্থিত নেতাদের আহ্বান জানান।
দৃশ্যমান ফলাফল পেতে সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাস্তব উদ্যোগের জন্য মৌলিক আইনি কাঠামো মজবুত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।
২০১৬ সালে ভারতের গোয়ায় বিশেষ বিমসটেক সভার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে নেওয়া ১৬টি এজেন্ডার মধ্যে কয়েকটি বাস্তবায়ন হয়েছে, যার অনেকগুলো এখনো বাকি।
বিমসটেককে সুসংহত, কার্যকর ও মনোযোগের কেন্দ্রে এনে এটি থেকে ভালো কিছু পেতে তিনটি প্রধান বিভাগ ধরে ১৪টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
তিন বিভাগের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন’ বিভাগে রয়েছে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, জ্বালানি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং কৃষি বিষয়ক সহযোগিতার বাড়ানোর পরামর্শ। ‘নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা’ বিভাগে নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পরামর্শ এবং ‘জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ’ বিভাগে রয়েছে সংস্কৃতি বিনিময় ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ।
সন্তোষ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, কয়েকটি বিমসটেক দেশ দ্বিপাক্ষিক আয়োজনে ইলেকট্রিসিটি গ্রিড কানেকশন করেছে। অন্য সবার অংশগ্রহণে এটি বিমসটেক ইলেকট্রিক গ্রিডে পরিণত হতে পারে।
সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাস এই অঞ্চলের দেশগুলোর সবারই শত্রু।
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলা এবং অভিযোজনে উদ্যোগ নিয়েছে এবং নিজস্ব অর্থায়নে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে।
সন্ত্রাস দমন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ সফলভাবে সন্ত্রাস মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে।
বাণিজ্য, বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি-অর্জনের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর উন্নয়ন নির্ভর করে। ক্ষুধা-দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা দূরীকরণসহ বৈষম্যহীন সুষম উন্নয়ন নীতি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ।
‘একটি বাড়ি, একটি খামার’, ‘আশ্রায়ন প্রকল্প’, ‘সবার জন্য শিক্ষা’, উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, সামাজিক নিরাপত্তা সহযোগিতা, সবার জন্য বিদ্যুৎ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্র সঞ্চয় উদ্যোগসহ তার সরকারের সময়ে বাংলাদেশে নেওয়া কিছু অনন্য (ইউনিক) পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
সরকারের বিভিন্ন জনবান্ধব পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার গত ১০ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি লাভ করেছে। যার কারণে মাথাপিছু আয় ১৭৫২ ডলারে উন্নীত হয়েছে, দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে বিশ্বে ৪৩তম বড় অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ওয়াটার হাউজ কপার বলছে ২০৫০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৩ নম্বর বড় অর্থনীতির দেশ। জাতিসংঘ মহাসচিব তার সাম্প্রতিক সফরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা করে এটিকে ‘মিরাকল’ বলেছেন।
২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার পুর্নব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা।