অনলাইন ডেস্ক: ‘তাঁরা (পুলিশ) রাত্রে আড়াইটা বাজে আমারে আমার বাসা থেকে তুইলা নিয়ে যায় এবং আমারে তাঁরা অত্যাচার করার পর বলছে যে, তোরে ক্রসফায়ার করমু। যদি তুই ৫০ লাখ টাকা দেস, তাইলে তোরে ক্রসফায়ার দিমু না। আমি কইছি, স্যার আমার পক্ষে টাকা দেওয়া সম্ভব না।’
এই কথাগুলো নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের ঠিকাদার ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম স্বপনের। । তাঁর অভিযোগ, ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছেন সোনারগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদ আলম এবং উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাধন বসাক।
জমি নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার স্বপন আদালতে একটি মামলাও দায়ের করেছেন। আদালত মামলাটি পুলিশ সুপারের (এসপি) বা সহকারী পুলিশ সুপারের (এএসপি) পদমর্যাদার কাউকে দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ওসি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
জাহিদুল ইসলাম স্বপন অভিযোগ করে বলেন, ‘মোস্তফার (শানিক বয়েল পলিমার লিমিটেডের মালিকের বড় ভাই) সঙ্গে ওসি সাহেবের কন্ট্রাক্ট হইছে। ৭ তারিখে (অক্টোবর) বিকেল ৪টায় কন্ট্রাক্ট হইছে যে, আমাকে তাঁরা এই বাড়ি থাইকা উঠায়া দিয়া মোস্তাফাকে বুঝায়া দিব। ৫০ লাখ টাকার কন্ট্রাক্ট হওয়ার পরে তাঁরা রাত্রে আড়াইটা বাজে আমাকে আমার বাসা থেকে তুইলে নিয়ে যায় এবং আমাকে তাঁরা এত অত্যাচার করার পরে আমাকে বলছে যে, তোরে ক্রসফায়ার করমু। যদি তুই ৫০ লাখ টাকা দেস, তাইলে তোরে ক্রসফায়ার দিমু না। আমি কইছি, স্যার আমার পক্ষে টাকা দেওয়া সম্ভব না।’
‘এসআই সাধনরে বলে, এবার তুমি মারো’
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে জাহিদুল ইসলাম স্বপন বলেন, ‘ওসি সাব প্রথমে আমার দুই হাতে তাঁর রুল দিয়া অনেকগুলা বাড়ি দিছে। আমার …. অনেকগুলা বাড়ি দিছে। এরপরে হাত-পা বাইনধা আমার পায়ের পাতায় প্রায় ১৫/২০টা বাড়ি দিছে। যখন আমি চিল্লাচিল্লি করি, তখন আবার এসআই সাধনরে বলে যে, এবার তুমি মারো। পরে এসআই সাধন আমার হাতে মারে, পায়ের তালুতে মারে। মাইরা যখন আমি অজ্ঞান হয়ে যাই, অজ্ঞান হইয়া গেলে পরে আমারে নিয়া যায় হাসপাতালে। আমি জ্ঞান ফিরলে দেখি যে, আমি হাসপাতালের টুলে বইসা আছি।’
আদালতে করা মামলায় স্বপন উল্লেখ করেন, সোনারগাঁও উপজেলার দত্তপাড়া এলাকায় প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের তাঁর একটি জমি রয়েছে। জমি থেকে তাঁকে সরিয়ে দিতে চাইছে, মেঘনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শানিক বয়েল পলিমার লিমিটেডের মালিকপক্ষ। এটা নিয়েই তাদের সঙ্গে বিরোধ ছিল স্বপনের।
ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হয়ে গত ৭ অক্টোবর মধ্য রাতে সোনারগাঁ থানার ওসি মোরশেদ আলমের নেতৃত্বে একদল পুলিশ জাহিদুল ইসলাম স্বপনকে তাঁর বাড়ি থেকে হাত-পা এবং চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যান। মামলার বর্ণনায় বলা হয়, পরে তাঁকে থানার একটি কক্ষে আটকে রেখে নির্যাতন চালান এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা। ওই সময় ওসি মোরশেদ আলম ও এসআই সাধন বসাক জমিটি ছেড়ে না দিলে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যার হুমকি দেন।
জাহিদুল ইসলাম স্বপন জানান, নির্যাতনের পরের দিন ৮ অক্টোবর বিকেলে পুলিশ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নুর জিম্মায় তাঁকে ছেড়ে দেন।
পরে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে জাহিদুল ইসলাম স্বপন বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আশোক কুমার দত্তের আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে জেলা পুলিশ সুপারকে তদন্ত করে আগামী ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
জাহিদুল ইসলাম স্বপনকে থানা থেকে নিজের জিম্মায় আনার বিষয়টি স্বীকার করেছেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু।
‘দৌড়াইয়া পড়ে গেছে, হাসপাতালে নিয়ে গেছি’
ঠিকাদার জাহিদুল ইসলাম স্বপনকে বাড়ি থেকে তুলে এনে নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওসি মোরশেদ আলম। ওই জমি নিয়ে আদালত থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা আছে বলে তিনি দাবি করেন।
ওসি মোরশেদ আলম দাবি করেন, ‘ওয়ান ফোর্টি ফাইভ (১৪৪ ধারা) আছে ওইখানে, রাতের আঁধারে তাঁরা ভুয়া কাগজপত্র করতেছিল। ঠিক আছে? তখন আমরা তাদের বাধা দিয়ে তাদের নিয়ে আসি, ঠিক আছে? ওরে যখন ধরতে গেছে, ঠিক আছে? তখনই সে দৌড়ায় পড়ে গেছে। আমরা তাঁকে মেডিকেল থেকে ট্রিটমেন্ট করায়া নিয়ে আসছি তো। থানায় আমাদের কাগজপত্র আছে তো। ওইডা ভয় দেহাইলে তো …. (হাসি)। এহন তো একটা জায়গার পরে আপনি যদি ওয়ান ফোর্টি ফাইভ নিয়ে আসেন, যদি ওয়ান ফোর্টি ফাইভ আদালত থেকে নিয়ে আসেন। সেই জায়গায় আমরা পরবর্তীতে দুই পক্ষরে বলছি যে, দুই পক্ষই ওই জায়গায় যাইতে পারবে না। ঠিক আছে? যেহেতু তাঁরা কখনো ওইখানে যায়নি, দুইপক্ষকে বলছি যে, কাগজপত্র দিয়ে যদি হয়, যার জায়গা সে যাবে।’
এদিকে আদালতের আদেশ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত মামলাটা আমলে নিয়া আদেশে বলেছেন যে, এসপি তদন্ত করবেন। এসপি, এএসপি পদমর্যাদার নিচে নয়, এমন কাউকে দিয়ে তদন্ত করিয়ে রিপোর্ট দাখিলের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।’
‘কয়েকটা বিষয় আদালত সুস্পষ্টভাবে জানতে চেয়েছেন যে, তাঁকে (জাহিদুল ইসলাম স্বপন) স্ত্রী- সন্তানদের সামনে থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল কি না, থানায় এনে নির্যাতন করা হয়েছিল কি না, পরে রাত্রে ৩টা ৪০ মিনিটে তাঁকে সোনারগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা করানো হয়েছে কি না এবং ৫০ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে কি না’, যোগ করেন মামলার আইনজীবী।
এ বিষয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমরা পিটিশনটি পুলিশ সুপার মহোদয় যে অফিসারকে এনডর্স করবেন আপনারা জানেন যে সে অবশ্যই এসপি পদমর্যাদার নিম্নে হবেন না। তো উনি যদি অভিযোগের সত্যতা পান, তাহলে সে সত্যতা সংক্রান্ত প্রতিবেদন পুলিশ সুপার মহোদয় আদালতে প্রেরণ করবেন।’
‘সেক্ষেত্রে বিচারক অবশ্যই সেখানে আরেকটি আদেশনামা দিবেন। আদেশনামা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া, যদি অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়, আমাদের বিভাগীয় বিধি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে সত্যতা সাপেক্ষে’, যোগ করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।