বাল্যকাল থেকে শুনে আসছি, শিক্ষা জাতির মেরুদ-। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। সত্যিই তাই। আর সেজন্য আমাদের দেশের পবিত্র সংবিধানেও শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংগত কারণেই দেশের সকল শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। যাইহোক, বঙ্গবন্ধু’র আমলে দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় একযোগে জাতীয়করণ করা হয়েছে। তারপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় আসলেও এটাতে কেউ আর হাত দেয় নি। কিন্তু বর্তমান সরকারের অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে দেশ এখন নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমান সরকার ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে একযোগে জাতীয়করণ করেছে। এখন প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল শ্রেণিতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে। প্রত্যক স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসার অবকাঠামো বৃদ্ধিসহ মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আরো কত কি। এগুলো নি:সন্দেহে খুবই চ্যালেঞ্জিং এবং দুঃসাহসিক কাজ। তবুও সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে এখনো জাতীয়করণের আওতায় আনা হলো না। অনেকেই বলতেই পারেন, সরকার যত দিচ্ছে, জনগণ তত চাচ্ছে। বিষয়টিকে এভাবে দেখা আদৌ উচিত হবে কিনা তা একবার ভাবা দরকার। মৌলিক অধিকার হিসেবে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা এখন সময়ের সবচাইতে আলোচিত দাবি। বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল এবং কলেজ জাতীয়করণ করার অংশ হিসেবে প্রতিটি উপজেলায় তাইই করা হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, সমাজের প্রভাবশালী মহলের বিশেষ করে কতিপয় সুবিধাবাদী জনপ্রতিনিধি এবং রাজনীতিবিদের প্রভাবে বিছিন্নভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হচ্ছে যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতীয়করণের সকল শর্তÑ এমন কি কখনো কখনো কোনো শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার অন্য একটি কুচক্রী মহলের কুপ্রভাবের ফলে জাতীয়করণকৃত হওয়ার জন্য সকল শর্ত পূরণ করে তালিকাভুক্ত থাকা যোগ্য বা উপযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও জাতীয়করণের তালিকা থেকে অজানা কারণে বাদ পড়ছে। যেটি আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লক্ষ্য করেছি এবং এখনো করছি। যা আদৌ কাম্য নয়। তবে স্বচ্ছতার সাথে মোটেও যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তবে তার সংখ্যা নিয়ে জনমনে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। এর ফলে জাতীয়করণ হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মুখে দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বল হাসির বর্ণছ্বটা। অপর দিকে জাতীয়করণের আশায় থাকা এমপিওভুক্ত ও দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার আলো ছড়ানো নন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের হতাশার পরিমান দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্লাস বন্ধ রেখে জাতীয়করণের দাবিতে হচ্ছে মানববন্ধন, বিক্ষোভ বা অনশনের মত নানা ধরনের কর্মসূচি। যা কখনো কখনো সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে। যার প্রমাণ কিছু দিন পূর্বে ময়মনসিংহে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর রাষ্ট্রীয় পেটোয়া বাহিনীর গুলিতে নিহত হন একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় কলেজ শিক্ষক। যা সরকারের জন্য মোটেই স্বস্তিকর নয়। এখন একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার প্রশ্ন, জাতীয়করণের শর্ত পূরণ করুক বা নাই করুক বিছিন্নভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ না করে বৈধভাবে সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে সরকারের বাঁধা কোথায়? সকল শিক্ষকদের যোগ্যতাতো একই। তাহলে কি ভাববো বিছিন্নভাবে জাতীয়করণ হওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি না করাটা ভুক্তভোগী শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা? যদি তাই হয়, সরকার তাহলে ঢালাওভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দিয়েছে কেনো? আর ঐসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের অনুমতি দিচ্ছে কেনো? তাহলে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বেতন না পাওয়া শিক্ষকদের উপায় কী? এদিকে আবার সরকার মহাশয় বলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশনি করতে পারবে না। সরকারতো এখন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরকে সরকারি বেতনের শতভাগ প্রদান করছে। বাকি আছে কিছু বাড়তি ভাতা। কিন্তু দেশের এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যার একটার আয় দিয়ে অন্য দশটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ঐ বাড়তি ভাতাগুলো দেওয়া কোনোভাবেই অসম্ভব নয়। তাহলে আপত্তিটা কোথায়? ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাবেক শিক্ষা সচিবের নিকট দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের উদ্যেশ্যে সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসেব চেয়েছিলেন। এতে করে স্পষ্টতই বোঝা যায়, আমাদের শিক্ষাবান্ধব বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে কতটাই আন্তরিক। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কতিপয় অসাধু আমলার কারণে প্রধানমন্ত্রী’র সেই সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করার মহতি উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে না। এখন স্বভাবইত প্রশ্ন উঠেছে, সরকার আমলাদেরকে চালাচ্ছে নাকি আমলারা সরকারকে চালাচ্ছে? তবুও দেশের মানুষ আশা করে অতি দ্রুত এই সরকারের পরবর্তী অর্থবছরের মধ্যেই দেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা হবে। দেশের গরিব-মেহনতী-কৃষক-দিনমজুরের সন্তানেরা বিনামূল্যে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে। সাথে সাথে জাতি গড়ার কারিগর আমাদের পিতৃতুল্য শিক্ষকবৃন্দ পাবেন সঠিক বেতন ও মর্যাদা। অন্যথায় একই শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্বেও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে রয়ে যাবে একটি আকাশ-পাতাল বৈষম্য। এতে করে সরকারি সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিক্ষকদের মনে ক্ষোভের আগুন দিন দিন বাড়তেই থাকবে। পাশাপাশি মেধাাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতার মত এই মহান পেশায় আশার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ফলশ্রুতিতে অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষা সেক্টর মেধা শূন্য হয়ে পড়বে। ভুগতে হবে গোটা বাঙালি জাতিকে।
লেখক: সাবেক সদস্য, কেন্দ্রীয় ছাত্র মৈত্রী এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাতক্ষীরা জেলা ছাত্র মৈত্রী ।