অনলাইন ডেস্ক: বর্তমান সরকারের আমলে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার একটা রেওয়াজ গড়ে ওঠেছে। গত কয়েকবছর ধরে পালন করা এ রেওয়াজ এবার পালন করা সম্ভব নাও হতে পারে। বই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে তৈরি হয়েছে সংকট।
আগামী ৩০ নভেম্বরের দেশের উপজেলা পর্যায়ে বই পৌছানো সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা অবশ্য লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রেখে শতভাগ বই পৌছানোর ব্যাপারে বেশ আশাবাদি। এরই মধ্যে সারাদেশ এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ পাঠ্যবই পৌঁছানো হয়েছে বলে এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে।
বিভিন্ন মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপা ও সরবরাহ সিংহভাগ সম্পন্ন হলেও মাধ্যমিকের বই নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
২০১৯ শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির ৩৬ কোটি ৬ লাখ পাঠ্যবইয়ের মধ্যে ২০ কোটি পাঠ্যবই অর্থাৎ ৪০ শতাংশ বই ছাপার কাজ এখনো চলছে। এসব বই মুদ্রণ শেষে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বই মুদ্রণের কাগজ সংকট, পরিবহন সমস্যা দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির অভিযোগ, এনসিটিবি পাঠ্যবই ছাপার কাজ মনিটরিং সরবরাহ অনুমোদন এবং পরিবহনে অসহযোগিতা ও বাধা সৃষ্টি করছে। তারা বলছেন, সময়মতো বিল না পেলে এবং মিলগুলো কাগজ সরবরাহ না করলে মাধ্যমিকের পাঠ্যবই ছাপানো ও সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেয়ার দাবি করেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা। তিনি বলেন, পাঠ্যবই নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা নেই। সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।
পাঠ্যবই নিয়ে উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক সমাধান চেয়ে এনসিটিবিকে চিঠি দিয়েছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত। তিনি বলেন, পাঠ্যবই মুদ্রণের ক্ষেত্রে এনসিটিবি কিছু অনাহুত সমস্যা সৃষ্টি করছে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য লিখিতভাবে বোর্ডকে জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, প্রাথমিকের বই ছাপা কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ব্যাংক ঋণ পরিশোধের বিল পাওয়া গেলে মাধ্যমিকের অবশিষ্ট বইয়ের কাজে হাত দেবে টেন্ডারপ্রাপ্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। ঢাকা, রাজশাহী ও বগুড়ার সাতটি বড় মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান এখনো কোনো বই দেয়নি। তারা বিল না পাওয়ায় বই ছাপার কাজ কমিয়ে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, নির্বাচনের কারণে কাগজের দাম বেড়ে গেছে। এ জন্য কাগজ কিনতে হচ্ছে বেশি দামে।
অন্যদিকে, বিল পরিশোধ করছে না এনসিটিবি। বই ছাপা হলেও পরিবহন সংকটের কারণে একাধিক লট আটকে ছিল। এখন আবারো রাস্তায় বই পড়ে থাকলে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে। সম্প্রতি পরিবহন ধর্মঘটের ফলে আটদিন পিছিয়ে গেছে, বই ছাপা, কাগজ সংগ্রহ এবং ছাপা বই পৌঁছানোর সব কার্যক্রম। তাই সমস্যার সমাধান চান তারা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ছাপা হচ্ছে ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২ কপি পাঠ্যবই। প্রাথমিক স্তরের ১১ কোটি ৬ লাখ ১ হাজার ৫২১ কপি বই ছাপিয়ে বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের বই ৬৮ লাখ ৫৬ হাজার ২০ কপি। প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৮৮ লাখ ৮২ হাজার ৮৯৯ কপি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার বই ২ লাখ ৭৬ হাজার ৭৮৪ কপি, ইবতেদায়ির ২ কোটি ২৫ লাখ ৩১ হাজার ২৮৩ কপি এবং দাখিলের ৩ কোটি ৭৯ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩৪ কপি বই। মাধ্যমিক (বাংলা সংস্করণের) স্তরের ১৮ কোটি ৫৩ হাজার ১২২ কপি এবং একই স্তরের ইংরেজি ভার্সনের ১২ লাখ ৪৭ হাজার ৮২৬ কপি বই ছাপা হচ্ছে। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষা স্তরের ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৪৮ কপি, এসএসসি ভোকেশনাল স্তরের ১ লাখ ৪৩ হাজার ৮৭৫ কপি, ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক ৫ হাজার ৮৫৭ কপি এবং সম্পূরক কৃষি (ষষ্ঠ-নবম) স্তরের ১ লাখ ২৪ হাজার ২৬১ কপি বই ছাপা হচ্ছে।
এসব বই ছাপাতে দেশি-বিদেশি প্রায় ৪০০ ছাপাখানার সঙ্গে চুক্তি করে কার্যাদেশ দিয়েছে এনসিটিবি। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দুটি ভারতের- ‘কৃষ্ণা ট্রেডার্স’ ও ‘স্বপ্না প্রিন্টার্স’। বাকিগুলো সবই দেশের। ঢাকা ছাড়াও এবার পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে বগুড়া, রংপুর, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীর ছাপাখানা থেকে। সারাদেশের প্রায় ৪শ’ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে (প্রিন্টিং প্রেস) পাঠ্যবই ছাপা, কাটিং ও বাইন্ডিংয়ের কাজে ব্যস্ত ৯৮ হাজার মানুষ।
এবার ৩৫ কোটি ২২ লাখ কপি বই ছাপাতে প্রায় ৮৫ হাজার টন কাগজ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে এনসিটিবি কিনে দিয়েছে প্রায় ১৫ হাজার টন কাগজ। বাকি কাগজ মুদ্রণকারীরা বাজার থেকে কিনে বই ছাপিয়ে সরবরাহ করছেন। এসব বই ছাপার পর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে কাজ করছে ১৬ হাজার ৪০০টি ট্রাক।
এদিকে দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর। কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন শ্রেণিতে উত্তীর্ণের প্রতীক্ষার পালা। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীরা খালি হাতে স্কুলে যাবে আর কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরবে ঝকঝকে তকতকে নতুন পাঠ্যবই নিয়ে। আগামী শিক্ষা বছরের জন্য ৩৫ কোটি বিনামূল্যেও পাঠ্যবই ছাপার কাজ চলছে। এবার ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে নতুন বই বিতরণ করা হবে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল বই এবং ৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের নিজ ভাষায় বই ছাপা হয়েছে।