দেশের খবর: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় ছাড়িয়ে যাবে ৪ হাজার কোটি টাকা। প্রার্থীদের ন্যূনতম ব্যয়, ইভিএম প্রকল্পে বরাদ্দ, নির্বাচন কমিশন ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যয়, আনসারদের অতিরিক্ত ভাতা ও আনুষঙ্গিক কাজে বিপুল এ অর্থ খরচ হবে। এটি প্রাথমিক হিসাব, যে কোনো কারণে তা বাড়তে পারে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, নির্বাচনে বিপুল এ ব্যয়ে অর্থনীতিতে সাময়িক প্রভাব পড়বে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ এসব টাকা উৎপাদনশীল খাতে আসবে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনে টাকার মালিকরা অংশ নিচ্ছে। ফলে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বেঁধে দেয়া সিলিংয়ের মধ্যে কোনো প্রার্থী তাদের ব্যয় আটকে রাখবে না। এতে আমাদের টাকা দিয়ে গণতন্ত্র কিনতে হবে। টাকার বিনিময়ে গণতন্ত্রের কোনো মূল্য নেই।
ব্যয় প্রসঙ্গে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নির্বাচন কমিশন ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয় অনুমোদন দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের আংশিক বাস্তবায়নে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রস্তুতিমূলক ব্যয় ৩০ কোটি টাকা, আনসারদের বর্ধিত ভাতায় ব্যয় হবে ২৪৩ কোটি টাকা। প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনতে ব্যয় হয়েছে ৩২ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্বাচনে তাদের খরচ হবে অন্তত ৯০০ কোটি টাকা।
নির্বাচন ঘিরে যানবাহন ও যাতায়াত, প্রিন্টিং, আপ্যায়ন, মাইকিং, সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারে বিপুল অর্থ খরচ হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে সামগ্রিকভাবে স্থানীয় পর্যায়ে কিছুটা প্রণোদনা সৃষ্টি হবে। তবে এ ধরনের প্রণোদনা শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে খুব একটা সহায়তা করে না। কারণ নির্বাচনকেন্দ্রিক টাকার বেশির ভাগ চলে যায় স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার ও রাজনৈতিক ফড়িয়াবাজদের কাছে। প্রিন্টিং ও উৎপাদনশীল খাতে কিছুটা গেলেও মাইকিং, আপ্যায়ন বা এ ধরনের খাত থেকে অর্থ উৎপাদন খাতে আসবে না।
ইসির সূত্রমতে, সারা দেশে ৪০ হাজার ১৯৯টি সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ৪০ হাজার ১৯৯ জন প্রিসাইডিং অফিসার, ৮০ হাজার সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং পাঁচ থেকে ছয় লাখ পোলিং অফিসারসহ প্রায় সাত লাখ নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্মী এবং ৫ লাখ আনসার সদস্য দেশব্যাপী নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত হবেন।
নির্বাচন কমিশনের ব্যয়: অনুমোদিত ব্যয় ৭৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে ৪৫০ কোটি এবং বাকি ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে পরিচালনা খাতে। আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয়ের মধ্যে আনসার সদস্যদের জন্য ১৯০ কোটি, পুলিশের জন্য ১৬৫ কোটি, সেনাবাহিনীর জন্য ৪৫ কোটি এবং র্যাব ও বিজিবির জন্য ৩০ কোটি টাকা। নির্বাচন পরিচালনা ব্যয়ের মধ্যে ১৬০ কোটি টাকা যাবে সাত লাখ নির্বাচন পরিচালনা কর্মীর পেছনে। এছাড়া দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনে ব্যালট পেপার ছাপাতে ৩০ কোটি, অন্যান্য মুদ্রণ সামগ্রী কেনায় ১০ কোটি, স্ট্যাম্প প্যাড, বিভিন্ন ধরনের সিল ও কালি কিনতে ব্যয় হবে ৮ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ইসির ব্যয় ছিল ২৯৩ কোটি টাকা।
প্রার্থীদের ব্যয়: নির্বাচন আইন অনুযায়ী, একজন প্রার্থী একজন ভোটারের পেছনে সর্বোচ্চ ১০ টাকা ব্যয় করতে পারবেন। আর সংশ্লিষ্ট আসনে ওই প্রার্থী সর্বোচ্চ খরচ করতে পারবেন ২৫ লাখ টাকা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসন্ন নির্বাচনে হাতেগোনা কয়েকজন বাদে কোনো প্রার্থীর ব্যয়ই কোটি টাকার নিচে থাকবে না। প্রতি নির্বাচনী আসনে যদি অন্তত তিনজন প্রার্থী থাকেন আর তারা গড়ে যদি ১ কোটি টাকা করে ব্যয় করেন, তবে আসনপ্রতি ৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ৩০০ আসনে যা ৯০০ কোটি টাকা।
মনোনয়ন ফরমে ব্যয়: মনোনয়ন ফরম কিনতে প্রার্থীদের এ বছর ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের খরচ হয় ১২ কোটি টাকা। দলটির ৪ হাজার মনোয়ন ফরম কিনেছেন প্রার্থীরা। সাড়ে ৪ হাজার ফরম কেনায় ১৩ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে বিএনপির প্রার্থীদেরও। জাতীয় পার্টির ফরম কিনেছেন ২৪১৮ প্রার্থী। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৫ কোটি টাকা।
ইভিএম প্রকল্পের ব্যয়: জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এজন্য সরকার ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এ বছরই প্রকল্পে বড় একটি অংশ ব্যয় হবে ইভিএম কেনাকাটা এবং এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের পেছনে। এ ব্যয় মেটাতে ১ হাজার ৯৯৮ কোটি ৯ লাখ টাকা চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ‘বিশেষ প্রয়োজন উন্নয়ন সহায়তা’ খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার ব্যয়: জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে নাশকতামূলক তৎপরতার আশঙ্কা আগে থেকেই রয়েছে সরকারের এজেন্সিগুলোর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাদের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের কর্মকাণ্ড আগের তুলনায় ব্যাপক হারে বাড়ানো হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে তাদের ব্যয়ও অনেক বেড়েছে। ফলে অতিরিক্ত এ আর্থিক চাপ মেটানোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ‘বিশেষ বরাদ্দ’ হিসেবে ৩০ কোটি টাকা প্রয়োজন। এটি অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে।
আনসার-ভিডিপির নির্বাচনী ভাতা: সারা দেশে ৪০ হাজার ১৯৯ কেন্দ্রে আনসার বাহিনীর ৪ লাখ ৮২ হাজার ২৩৮ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচনের সময় পাঁচ দিনের দায়িত্ব পালনে আনসার-ভিডিপির ভাতা বাবদ মোট ২৪৩ কোটি ৩৭ লাখ ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে অর্থ বিভাগের কাছে। এর মধ্যে সমতল ভূমিতে ৩৯ হাজার ৬২৯টি ভোট কেন্দ্রের ব্যয় দেখানো হয় ২৩৯ কোটি ৭৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা এবং পাহাড়ি অঞ্চলের ৫৭০টি ভোট কেন্দ্রের ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩ কোটি ৬১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।