অনলাইন ডেস্ক: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশি-বিদেশি পাঁচটি বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এনজিও বিষয়ক ব্যুরোকে চিঠি দিয়েছে। এমনকি নিউইয়র্কভিত্তিক এনজিও ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’কে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য বিদেশি অর্থ ছাড় না দিতে অনুরোধ করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
গত ১৯ ডিসেম্বর এনজিও ব্যুরোতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়- জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে এনজিওবিষয়ক সংস্থা ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’সহ কয়েকটি দেশি এনজিওকে নজরদারিতে রাখতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। নজরদারিতে থাকা এনজিওগুলো হলো- আন্তর্জাতিক এনজিও দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।
বিদেশি অনুদানে পরিচালিত এনজিওগুলোর বেশিরভাগই ‘অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। আইনি বিধিনিষেধে শাস্তির শঙ্কায় কোনো কোনো এনজিও নাগরিক সংগঠনের ব্যানারে নির্বাচনে ভূমিকা রাখছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এনজিওগুলোর নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যক্রম ও তৎপরতায় দাতাদের প্রভাব থাকে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের অর্থ ছাড় করার জন্য এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মাধ্যমে ১৯টি এনজিও তাদের আবেদন করেছে। এগুলোর একটি ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’। বদিউল আলম মজুমদার এনজিওটির কান্ট্রি ডিরেক্টর। তিনি এটির আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। নিউইয়র্কভিত্তিক এ এনজিও বিভিন্ন দেশে অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি ‘গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য’ একটি প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত বদিউল আলম সুজনের সাধারণ সম্পাদক। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট ছাড়াও সুজন, টিআইবি, ব্লাস্ট ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম সরকারবিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এ জোটের নেতৃত্ব দানকারী বিএনপির দাবি আদায়েও এ এনজিওগুলো সহযোগী ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব উদ্দেশ্য সফল করতে এই এনজিওগুলোর সরকারবিরোধী কার্যক্রমের আড়ালে রাষ্ট্র ও দেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে এসব এনজিও নানা ধরনের প্রশ্ন ও বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। তাই এদের বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম ও সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিদেরও নজরদারিতে রাখতে বলা হয়েছে। তাদের চলতি বছরের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের দেখভাল করতে এবং পরে বিদেশি অর্থ ছাড় বিষয়েও সতর্ক থাকতে বলেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক কেএম আব্দুস সালাম বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী এনজিওগুলোর ওপর খেয়াল রাখা হচ্ছে। প্রয়োজনে এনজিও ব্যুরোর নিয়মানুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের সব প্রকল্প মনিটরিং করা হচ্ছে।
এনজিওগুলোয় সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়ে মহাপরিচালক বলেন, ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণ করার বিষয়ে কিছু আইনি সীমাবদ্ধতা আছে। আইনানুযায়ী যেটা করা যায়,সেটা করছি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এনজিওকেন্দ্রিক নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের কেউ কেউ ভূমিকা রাখেন। এদের মধ্যে কেউ নেতিবাচক কার্যক্রমে জড়িত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার যে কোনো বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) নজরদারি করতে পারে। এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন টিআইবির অনুষ্ঠানগুলোতে এসে বসে থাকে। এ জন্য টিআইবি উদ্বিগ্ন নয়। কারণ এ সংগঠন এমন কোনো কাজ করে না, যেটা রাষ্ট্রবিরোধী। সরকারের সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই টিআইবি কাজ করে থাকে। তাই এ সংবাদকে হাস্যকরই মনে করি। কারণ, এটি টিআইবি সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাবের পরিচায়ক।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তিনি এবং তার সংগঠন সরাসরি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কাজে জড়িত নন। মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি। তিনি বলেন, সুজনের উদ্যোগে মূলত হলফনামায় প্রার্থীদের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তুলনামূলক চিত্র দাঁড় করানো হয়। এটি ভোটারদের তথ্যভিত্তিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে। যার ফলে তারা ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একই সঙ্গে সুজন নতুন ভোটারদেরও সচেতন এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ বিষয়ে উদ্যোগী করে তোলে। সুজন সম্পূর্ণ দলনিরপেক্ষভাবেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে এবং কোনোভাবেই রাষ্ট্র বা সরকারবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত নয়। সুজনের সব কার্যক্রমই দৃশ্যমান।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন জানান, এ খবর শুনে তিনি হতভম্ব। কারণ, ব্লাস্ট নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রমেই জড়িত নয়। তিনি প্রশ্ন করেন, এখানে নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রশ্ন আসে কীভাবে? তার মতে, ব্লাস্ট একটি আইনি সহায়তার সংস্থা। যারা অর্থের অভাবে আইনি সহায়তা পায় না, তাদের জন্য কাজ করে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, এনজিও ব্যুরোর বেশ কিছু কাজ রয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি অর্থে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থাগুলোকে (এনজিও) দেখভাল করা। ব্লাস্ট আইনি সহায়তা দেয়। কিন্তু তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি-না, তা এখনও অস্পষ্ট। আর এনজিও ব্যুরো এনজিওর ওপর নজরদারি করতেই পারে। এ কাজ তারা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমেই করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, কোনো এনজিও ভুল তথ্য দিলে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে কোনো কারণ ছাড়াই এগুলোকে নজরদারিতে রাখা যায় না। একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে এনজিওর ভূমিকাকে তিনি ইতিবাচকভাবেই দেখেন।