দেশের খবর: নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের তোড়জোড়ের মধ্যেই তৃণমূল থেকে বেশি মন্ত্রী করার চাপ আসছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা নিজ নিজ এলাকার নির্বাচিত এমপিদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়ার দাবি তুলছেন। এক্ষেত্রে পছন্দের এমপিদের নানা ‘গুণ’ তুলে ধরে দলীয় হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। খোদ দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও অনেককে মন্ত্রী করার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। নতুন এমপিদের অনেকেই বিভিন্নভাবে যোগাযোগ রাখার চেষ্টাও করছেন দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে। এলাকায় মন্ত্রী থাকলে উন্নয়ন দ্রুত হয়- এ বিশ্বাস থেকেই তারা এ দাবি তুলছেন।
তবে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করছে মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়টি। কাকে মন্ত্রী করা হবে- সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সেটি তিনিই ঠিক করবেন। সে কারণেই তার দিকেই মূলত তাকিয়ে রয়েছেন তৃণমূল নেতারা। এর পরও নিজ নিজ এলাকার এমপিদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী করার দাবিতে অনেক এলাকায়ই মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ অথবা সংবাদ সম্মেলনও করে যাচ্ছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
আগামী সোমবার নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেবেন। বিকেল সাড়ে ৩টায় বঙ্গভবনে শপথ পড়াবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এর আগে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ হাসিনার শপথও পড়াবেন তিনি। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ ও শপথ পাঠ করানোর এখতিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের।
এর আগে বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের নবনির্বাচিত ২৮৯ এমপি শপথ নেন। পরে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভায় সংসদ নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় একাদশ জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান রাষ্ট্রপতি।
তৃণমূল নেতাদের মতে, মন্ত্রিসভায় এলাকার প্রতিনিধি থাকলে এলাকার উন্নয়নে সুবিধা হয়। আবার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কাছে নিজেদের সুখ-দুঃখ তুলে ধরে প্রতিকার পাওয়াটাও সহজ হয়। এ কারণেই তারা মন্ত্রিসভায় নিজ এলাকার প্রতিনিধিদের দেখতে চাইছেন। কেউ কেউ বিদায়ী মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের পূর্ণ মন্ত্রী করার পক্ষে দাবি তুলেছেন। অনেক এমপিও নিজেদের নাম মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে লবিং-তদবির চালাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক এবার দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো টাঙ্গাইল-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর মহাজোট সরকারের খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। নতুন মন্ত্রিসভায় তাকে পূর্ণমন্ত্রী করার দাবি জানিয়েছেন দলের টাঙ্গাইলের তৃণমূল নেতারা।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদার সিলেট-৫ আসন থেকে তৃতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। বর্ষীয়ান এই নেতাকে মন্ত্রী করার দাবিতে বিবৃতি দিয়েছেন তার নির্বাচনী এলাকা কানাইঘাট উপজেলা ও পৌরসভা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এবার নিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন কুষ্টিয়া-৩ আসন থেকে। এলাকার তৃণমূল নেতারা মন্ত্রিসভায় দেখতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এই বিশেষ সহকারীকে। আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ২০০৮-এর নির্বাচন থেকে টানা তিনবার এমপি হয়েছেন চাঁদপুর-৩ আসন থেকে। এক মেয়াদে মহাজোট সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও ২০১৪ সালের পর বাদ পড়ে যান। আবারও তাকে মন্ত্রিসভায় দেখার প্রত্যাশা রয়েছে এলাকাবাসীর।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন দলের অন্য দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও বি এম মোজাম্মেল হক। তবে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে দলের নির্বাচন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তারা। ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক এমপি নানক, ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক এমপি রহমান, মাদারীপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি নাছিম এবং শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক এমপি মোজাম্মেলের এই ‘ত্যাগ’কে মূল্যায়ন করে টেকনোক্র্যাট কোটায় তাদের কাউকে কাউকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির দাবি জানাচ্ছেন নিজ নিজ এলাকার নেতাকর্মীরা।
সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জয়পুরহাট-২ এবং খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দিনাজপুর-২ আসনের একাধিকবারের নির্বাচিত এমপি। তাদের মন্ত্রিসভায় দেখার প্রত্যাশা রয়েছে এই দুই জেলার নেতাদের। আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম এবারই প্রথম এমপি হয়েছেন শরীয়তপুর-২ আসন থেকে। নতুন মন্ত্রিসভায় তার ঠাঁই হবে বলে প্রত্যাশা রয়েছে এলাকার নেতাকর্মীদের।
দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ও বরিশাল জেলা সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে এবার নিয়ে চারবার এমপি হয়েছেন বরিশাল-১ আসন থেকে। ১৯৯৬ সালে পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদায় জাতীয় সংসদের চিফ হুইপের দায়িত্বলাভের পর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি করাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। বর্তমানে পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদায় পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থেই তাকে এবার মন্ত্রিসভায় দেখতে চাইছেন তার নির্বাচনী এলাকা বরিশালের গৌরনদী-আগৈলঝাড়াসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলবাসী।
প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়নে পিরোজপুর-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন দলের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম। তাকে মন্ত্রিসভায় দেখার প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন পিরোজপুরের নেতারা।
বিদায়ী মন্ত্রিসভার অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এবার নিয়ে টানা তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে। তাকে এবার পূর্ণমন্ত্রী করার দাবি উঠেছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান ও জগন্নাথপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রিজু বলেন, এম এ মান্নান এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় যে উন্নয়ন হয়েছে, তা গত ৪০ বছরেও হয়নি। এ কারণেই এলাকাবাসী তাকে পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে চাইছেন।
সাতক্ষীরা-৩ আসন থেকে এবার নিয়ে টানা তিনবার এমপি হয়েছেন ডা. আ ফ ম রুহুল হক। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তাকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী করা হয়েছিল। নতুন মন্ত্রিসভায় তাকে আবারও মন্ত্রী করার দাবিতে সাতক্ষীরায় বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন হয়েছে স্থানীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে।
একইভাবে কুড়িগ্রাম-৪ আসনের টানা দ্বিতীয়বারের এমপি জাকির হোসেনকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির দাবিতে শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করেছে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা ছাত্রলীগ। পটুয়াখালী-৪ আসনের নবনির্বাচিত এমপি অধ্যক্ষ মহিব্বুর রহমান মহিবকে মন্ত্রী করার দাবিতে মানববন্ধন করেছেন এলাকার সর্বশ্রেণির মানুষ।
এবারই প্রথম মাগুরা-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এপিএস অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর। তাকে মন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন মাগুরার তৃণমূল নেতারা। একইভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসন থেকে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত এমপি ডা. সামিল উদ্দিন শিমুলকে নতুন মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন তার নির্বাচনী এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার নেতাকর্মীরা।
এবারের নির্বাচনে অন্যতম চমক ছিল বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। নড়াইল-২ আসন থেকে বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন তিনি। তাকে নতুন মন্ত্রিসভার ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার দাবি উঠেছে এলাকা থেকেই। একই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়ার দাবি উঠেছে মানিকগঞ্জ-১ আসনের টানা দুইবারের এমপি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাবেক টেস্ট অধিনায়ক এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয়কেও। টানা তিনবারের নির্বাচিত এমপি নড়াইল-১ আসনের বি এম কবিরুল হক মুক্তিকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলেছেন তার নির্বাচনী এলাকা নড়াইলের কালিয়ার নেতারা।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবার নিয়ে টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চাঁদপুর-১ আসন থেকে। ১৯৯৬ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট কোটায় প্রতিমন্ত্রী ও ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর মহাজোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন দলের সাবেক এই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। এবার নতুন মন্ত্রিসভায় তাকে আবারও পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন তার নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুরের কচুয়ার নেতাকর্মীরা। একইভাবে প্রথমবার নির্বাচিত হওয়া চাঁদপুর-৪ আসনের এমপি ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমানকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তি চাইছেন চাঁদপুরের নেতাকর্মীরা।
বরগুনার নেতাকর্মীরা নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করে তাদের এলাকায় মন্ত্রী চাইছেন। ১৯৯৬ সালের পর থেকে এই জেলা থেকে কাউকে মন্ত্রী করা হয়নি এমন দাবি করে এবার বরগুনা-১ আসনের এমপি ও সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু অথবা বরগুনা-২ আসনের শওকত হাচানুর রহমান রিমনকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির দাবি করেছেন স্থানীয় নেতারা।
পটুয়াখালী-২ আসন থেকে সাতবারের নির্বাচিত এমপি ও বিদায়ী সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজকে মন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান তার জেলার নেতাকর্মীরা। আর পটুয়াখালী-১ আসন থেকে নির্বাচিত তিনবারের এমপি ও সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়াকে মন্ত্রী হিসেবে চাচ্ছেন পটুয়াখালীবাসী। ময়মনসিংহ-৬ আসন থেকে ছয়বারের নির্বাচিত এমপি মোসলেম উদ্দিনকে মন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান তার নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়াসহ ময়মনসিংহ জেলার নেতাকর্মীরা। একইভাবে দুই থেকে চারবার নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে নরসিংদী-৪ আসনের অ্যাডভোকেট নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, কুমিল্লা-১ আসনের মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া, সুনামগঞ্জ-৫ আসনের মুহিবুর রহমান মানিক, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না, টাঙ্গাইল-৭ আসনের একাব্বর হোসেন, ঢাকা-১৯ আসনের ডা. এনামুর রহমান, ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদ, নওগাঁ-১ আসনের সাধন চন্দ্র মজুমদার, যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিন, ময়মনসিংহ-৫ আসনের কে এম খালিদ বাবু এবং নরসিংদী-২ আসনের ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপসহ অনেককেই নতুন মন্ত্রিসভায় দেখার প্রত্যাশা করেছেন সংশ্নিষ্ট এলাকার তৃণমূল নেতাকর্মীরা।