বহির্বিশ্ব: ডালিম হোটেল চট্টগ্রামবাসীর চোখে এক বিভীষিকার নাম; চলতি পথে এখনও ঘৃণাভরে ডালিম হোটেলের দিকে তাকায় সাধারণ মানুষ। ৭১-এ এটি মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের জন্য হয়ে উঠেছিলো যেনো এক ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’। সেখান থেকে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা ও নিরপরাধ বাঙালির কান্নার আওয়াজ যেন এখনও কানে বাজে। মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় ৪৪ বছরের ক্ষোভ ও দুঃখ-বেদনার অবসান হলো।
ঠিক কতো মানুষকে এখানে নির্যাতন এবং নির্যাতনের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিলেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ৭১-এ মীর কাসেমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বদর এ টর্চার সেলে সাধারণ মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
ঠিক এমনই ভাবে হত্যা করা হয়েছিলো কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে। তাকে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এই জসিম হত্যার অপরাধেই আজ চট্টগ্রামের জল্লাদ মীর কাসেমকে ফাঁসির দড়িতে ঝুঁলতে হলো।
বদর বাহিনী তাদের টর্চার সেলের জন্য বেছে নিয়েছিলো টেলিগ্রাফ রোডের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাটি। সেখানেই ৭১’র মার্চে চন্দ্র মোহন নাথের মহামায়া ভবন দখল করে মীর কাসেম গড়ে তুলে ছিলেন টর্চার সেল ডালিম হোটেল। ভবনটির মালিক চন্দ্র মোহন নাথ ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম শহরের পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডে ৬ শতক জমির ওপর তিন তলা মহামায়া ভবন নির্মাণ করেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাসখানেক পরই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতে চলে যান চন্দ্র মোহন নাথ। তার অনুপস্থিতিতে যুদ্ধের সময় এটি নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর আল বদর সদস্যরা।
মুক্তিযুদ্ধে আল বদর বাহিনীর চট্টগ্রামে অঞ্চলের হেডকোয়ার্টার হিসেবে পরিচয় পেয়েছিলো ডালিম হোটেল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ডালিম হোটেলকে নরকে পরিণত করেন মীর কাসেম আলী। এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকজনকে ধরে এনে পা ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চলানো হতো, প্রস্রাব করে তা পানে বাধ্য করা হতো, বৈদ্যুতিক শক দেয়া হতো। নির্যাতনের কারণে অনেক বাঙালির মৃত্যু হয়েছে। সেখানে বন্দি নির্যাতনের আর্তনাদ আজও তাড়িয়ে বেড়ায় অনেককে।
মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিরোধে প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের ও মুক্তিকামী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালাতো, হত্যা করতো এবং মরদেহ গুম করে ফেলত।
মীর কাসেম আলী ও তার আলবদর বাহিনী তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিকামী মানুষের জন্য আবির্ভূত হয়েছিল ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। কাসেম ছিলেন চট্টগ্রামের বিভীষিকা। তার জল্লাদখানার নাম দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ের চামড়ার গুদাম, সালমা মঞ্জিল এবং ডালিম হোটেলসহ ৫টি নির্যাতন কেন্দ্র।
মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ বিবেচনায় ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে জসিমসহ মোট আটজনকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ আদালত তার আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছে। তবে ১১ নম্বর অভিযোগে জসিম হত্যার ঘটনায় সর্বোচ্চ সাজার রায়ই বহাল রাখায় তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুঁলতে হলো।
পূর্ববর্তী পোস্ট