অনলাইন ডেস্ক : চলমান সিরীয় গৃহযুদ্ধে মার্কিন বাহিনী ক্ষতিকর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই দুই দফায় ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম নামের এইসব অস্ত্র ব্যবহারের কথা স্বীকার করেছে। পেন্টাগন সূত্রকে উদ্ধৃত করে ইয়ারওয়ারস এবং ফরেন পলিসি জানিয়েছে, আইএসবিরোধী বিমান অভিযানে ওইসব রাসায়নিক ফেলা হয়েছে। ২০০৩ সালের ইরাক আগ্রাসনের সময় ব্যবহৃত এই অস্ত্রগুলো ক্যানসার আর জন্মত্রুটির কারণ হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এই কর্মকাণ্ডে বিষ্ময় প্রকাশ করেছে ইউরেনিয়াম অস্ত্র নিষিদ্ধে গঠিত আন্তর্জাতিক জোট।
ইয়ারওয়ার ইরাক, সিরিয়া আর লিবিয়ায় মার্কিন বিমান হামলায় বেসামরিক হতাহতের ঘটনা পর্যবেক্ষণে গঠিত এক অলাভজনক সংগঠন। আর কূটনীতি বিষয়ক বিশ্লেষণাত্মক সংবাদমাধ্যম ফরেন পলিসি। তাদের প্রকাশিত যৌথ উদ্যোগের প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত খবরটি সামনে এসেছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের অধীনে থাকা সামরিক অভিযানের পর সেন্ট্রাল কমান্ডের একজন মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে তারা জানিয়েছে, ২০১৫ সালে নভেম্বরের ১৬ এবং ২২ তারিখে দুই দফায় সবমিলে ৫ হাজার রাউন্ডেরও বেশি পরিমাণে ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম ব্যবহার করেছে মার্কিন বাহিনী।
ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম বলতে কম উন্নত বা ঈষৎ রূপান্তরিত ইউরেনিয়াম বুঝায়। ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়ামের তৈরি অস্ত্র তাৎক্ষণিকভাবে পরমাণু অস্ত্রের মতো ব্যাপক বিধ্বংসী না হলেও তার স্বল্প-মেয়াদী ও দীর্ঘ-মেয়াদী প্রভাব পরমাণু অস্ত্রের মতোই।
মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের একজন মুখপাত্র মেজর জস জ্যাক। ইয়ারওয়ার আর ফরেন পলিসিকে তিনি জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের ১৬ আর ২২ নভেম্বর দুই দফায় সিরিয়ার মাটিতে ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম ব্যবহার করেছে মার্কিন বাহিনী। আইএসবিরোধী দু’টি ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে এই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে তারা। জ্যাক জানান, দু’দিনেই ৫০০০ রাউন্ডেরও বেশি পরিমাণে ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম সমন্বিত সিফেআরক ছুড়েছে বিমান থেকে। আইএসের তেলবাহী ট্যাংকের উপর এটা ছুঁড়েছিল এ-১০ যুদ্ধবিমান। ওই অভিযানে ৩৫০টি ট্রাক বিধ্বস্ত হয়।
একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে পেন্টাগন ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ অস্ত্র ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেছিল। সিরিয়া এবং ইরাকের জন্য গঠিত মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের একজন মুখপাত্র ক্যাপটেন জন মুর তখন বলেছিলেন, ‘অতীতেও মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। ভবিষ্যতেও ব্যবহার করা হবে না।’ তবে প্রতিশ্রুতি রাখেনি তারা।
ওই বছরের শেষের দিকে এসেই (নভেম্বর, ২০১৫) সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে হামলাকারী মার্কিন জোট। ‘অপারেশন টাইডাল ওয়েব টু’ নামের এক আইএসবিরোধী অভিযানের পরিকল্পকরা সিদ্ধান্ত নেন, আইএসের তেলবাহী ট্রাকগুলোকে ধ্বংস করতে ইউরেনিয়ামই হতে পারে মোক্ষম অস্ত্র। সেই অনুযায় এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে তারা। সেন্ট্রাল কমান্ডের মুখপাত্র মেজর জ্যাক দ্বিধাহীনভাবে জানান, আসলে মার্কিন বাহিনী আইেসর ট্রাকগুলোর সমূলে উৎপাটিত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল।
এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহারে জনস্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে যখন কসোভোতে এই ধরনের অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। তখন প্রভাবিত অঞ্চলগুলো থেকে শিশুদের সরিয়ে নিতে বলেছিল জাতিসংঘ। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং ২০০৩ সালের ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের সময়েও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্রর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তারা। যুদ্ধে মার্কিন সেনারা ইরাকি জনগণের ওপর ইউরেনিয়ামযুক্ত অন্তত পাঁচ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে। ইরাকিদের টার্গেট করে মার্কিন ‘টেন ফেয়ারচাইল্ড’-এ কামান থেকে ছোঁড়া হয়েছে ত্রিশ মিলিমিটার সাইজের নয় লাখ চল্লিশ হাজার গোলা। এইসব গোলাও ছিল তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ।
যুদ্ধের পর সারা ইরাকের গাছপালা, ফসল, পশু ও মানুষের ওপপর ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তাজনিত প্রভাব পড়তে শুরু করে। ইরাকের সরকারি হিসেবে, ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ক্যানসার ছিল ৪০ জনের। যুদ্ধের ৪ বছর পর এক লাখে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮০০ জনে আর বুশ-ব্লেয়ারের মার্কিন আগ্রাসনের পর ইরাকে প্রতি এক লাখে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬০০ জনে।
ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে ফালুজাতে। ইরাক যুদ্ধের পর ফালুজা অঞ্চলে বিগত ১১ বছরে যত শিশু জন্ম নিয়েছে, তার ৬০ শতাংশই বিকলাঙ্গ। ২০১১ সালে ডিসেম্বরের ২১ তারিখে এক হাসপাতালকর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল আলজাজিরা। ১৯৯৭ থেকে ফালুজার হাসপাতালে কাজ করা আলানি নামের এক নারী আলজাজিরাকে জানিয়েছেন, ২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে ২ বছর ২ মাসে ত্রুটিপূর্ণভাবে জন্ম নেওয়া ৬৭৭টি শিশুকে নথিভূক্ত করেছেন তিনি। ৮ দিন পর ২৯ ডিসেম্বর সেই ফালুজায় গিয়ে আলজাজিরার অনুসন্ধানকারীরা জানতে পারে, সেই সংখ্যাটি ২২ জন বেড়ে ৬৭৭ থেকে ৬৯৯-তে দাঁড়িয়েছে।
ইউরেনিয়াম অস্ত্রের নিষিদ্ধকরণে কোনও আন্তর্জাতিক চুক্তি নাই। এ সংক্রান্তক চুক্তির জন্য গঠিত জোটের আন্তর্জাতিক সমন্বয়ক ডগ ওয়েরের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, ‘ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম ব্যবহার করায় আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দা জানানো হয়েছে।’
২০১৪ সালে ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ সমরাস্ত্র বিষয়ক জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি) বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়ামের অবশেষ মাটি, সবজি, পানি এবং পৃথিবীর উপরিভাগে ছড়িয়ে প্রকৃতিকে দূষিত করলেও স্থানীয় জনগণের উপর খুব বেশি তেজস্ক্রিয় প্রভাব ফেলে না।’ তবে ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ভারি মাত্রায় ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়ামের সংস্পর্শে আসলে উল্লেখযোগ্য তেজস্ক্রিয়তা লক্ষ্য করা যেতে পারে।’
সিরিয়ায় মার্কিন জোটের বিমান থেকে আবারও ক্ষতিকর রাসায়নিক ফেলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেননি মার্কিন বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের মুখপাত্র মেজর জ্যাক। ভবিষ্যতে দূষণমুক্ত করার জন্য হামলাস্থলগুলো চিনে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে ওই অঞ্চলগুলো এখনও আইএসের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি।