বাংলাদেশ যতো বেশি রফতানি করতে পারবে তত বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। রফতানি বানিজ্য জোরদার হলে দেশের অর্থনৈতিক ভিতও শক্তিমান হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে রফতানি বানিজ্য নিয়ে কারও কোনো প্রকার দ্বিমত থাকার কথা নয়। আশার কথা বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রফতানি করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। চা, মাছ , গার্মেন্টস , চামড়া রফতানির পরও বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়পড়তা ৫০ হাজার টন সুগন্ধি সরু চাল রফতানি করে আসছে। এবার প্রশ্ন উঠছে মাঝারি ও মোটা চাল রফতানির বিষয় নিয়ে।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্টাটিসটিকস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৮/২০০৯ অর্খবছরে বাংলাদেশে চাল উৎপাদনের পরিমান ছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০০৯/২০১০ অর্থবছরে ৩ কোটি ২২ লাখ ৫৭ হাজার টন, ২০১০/২০১১ অর্থবছরে ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৪১ হজিার টন, ২০১১/২০১২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৮৯ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়। ২০১২/২০১৩ অর্থবছরে উৎপাদিত চালের পরিমান ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ১৪ হাজার টন, ২০১৩/২০১৪ তে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার টন, ২০১৪/২০১৫ তে তা দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ টনে, ২০১৫/২০১৬ তে তা দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টনে। ২০১৬/২০১৭ অর্থবছরে চাল উৎপাদিত হয় ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন । তবে ২০১৭/২০১৮ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের হিসাব এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। তবে আগের বছরগুলির তুলনায় এবারের উৎপাদন ঢের বেশি।
বিবিএসএর এই হিসাব ও দেশের মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যমতে দেশে চালের উৎপাদন বেড়েই চলেছে । বাংলাদেশের জন্য এটা সুখবরই বটে। এতো উৎপাদনের পরও চলতি অর্থবছরের ৩ জুন পর্যন্ত ২ লাখ পাঁচ হাজার টন চাল বাংলাদেশে আমদানি করা হয়েছে। আরও প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার টন চাল আমদানির পথে। এর কারণ চালের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারবো না।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যায় বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ চাল কিনে খায়। ২০ শতাংশ মানুষ তাদের নিজেদের উৎপাদিত চাল খায়। বর্তমান সময়ে আমাদের চাল উৎপাদন এতোটাই মাত্রা লাভ করেছে যে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে। এখন প্রয়োজন এর সুষম বন্টন ও ব্যবহার। ধান চাষীদের সৌভাগ্য তারা অঢেল ধান দিতে পেরেছেন। তাদের দুর্ভাগ্য তারা ধানের দাম পাননি। সরকার যে ধান কেবলমাত্র তালিকাভূক্ত কৃষকের কাছ থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে কিনছেন , সেই একই ধান মিল মালিক ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা কিনছেন অর্ধেক দামে প্রতি কেজি ১২ /১৩ টাকায়। মাঠে ধান থাকতেই মহাজনের তাগিদ সইতে না পেরে তা কৃষকরা কম দরে এমনকি বাকিতেও বিক্রি করে দিয়েছেন। এর পর যে ধান এখন তাদের হাতে আছে তা হয়তো কম দামেই কিছুদিনের মধ্যে বেচাকেনা হয়ে যাবে। এর মধ্যে সরকার তালিকাভূক্ত চাষীদের কাছ থেকে চাল কিনছেন। সরকার ১৩ লাখ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিলেও কৃষকের কাছ থেকে কিনবেন মাত্র দেড় লাখ টন। এ থেকে আসবে ১ লাখ টন চাল। বাকি ১২ লাখ টন কেনা হবে নিবন্ধিত চালকল থেকে। তবে কৃষি মন্ত্রী ঘোষনা দিয়েছেন সরকার তালিকাভূক্ত কৃষকদের কাছ থেকে আরও আড়াই লাখ টন ধান ক্রয় করবে। এতো উৎপাদনের পরও সরকার সামান্য পরিমান চাল কিনছেন এটা বড়ই বৈষম্যমূলক। কারণ এতে কৃষকের লাভের ভাগ নেই এক কানাকড়িও।
বাস্তবতা হচ্ছে সরকার যে ধান ২৬ টাকা মণ দরে কিনছেন, সেই একই ধান মিলাররা কিনেছেন ১২ থেকে ১৪ টাকা কিংবা তার চেয়ে কিছু বেশি দরে। এই ধান থেকে তৈরি চাল বিক্রি হবে সর্বনি¤œ ৩৬ টাকা দরে। আর সরকার তা রফতানি করলে লাভ হবে মিলারদের, চাষীদের নয়। কারণ কম টাকার ধানের চাল বেশি টাকায় বিক্রি করছে বেসরকারি রফতানিকারক ও মিল মালিকরা। কাজেই এক কথায় বলা যায় অধিক ধান চাল উৎপাদন করে চাষীরা লোকসানের ঘানি টানছেন । আর মিলাররা বিদেশে চাল রফতানি করে সবটুকু লাভ চুষে নিচ্ছেন। কথায় বলে ‘হাঁসে ডিম পাড়ে খায় দারোগা বাবু’। এমনিতেই দুর্যোগ প্রবণ দেশ বাংলাদেশে ঝড় বন্যা লেগেই আছে। দুর্যোগে তার ফসলহানি নৈমিত্তিক ব্যাপার। এরপরও লোকসানে বাকিতে ধান বিক্রি । কৃষক বাঁচবে কিভাবে।
আমাদের কৃষককে আরও বেশি প্রণোদনা দিতে হবে। সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। আর কৃষিতে আরও ভর্তূকি দিতে হবে কৃষককে। সস্তা দামে তাদের সার বীজ কৃষি উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। কৃষককে ধান চাল বিকিকিনির বাজার দেখিয়ে দিতে হবে। না হলে কৃষক লোকসানের ভয়ে যদি একবার বেঁকে বসেন এবং ধান উৎপাদনে ঢিল দেন তাহলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা পরনির্ভরতায় চলে যেতে পারে। বাস্তবে চাল রফতানি করে দেশের ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন কিন্তু কৃষকের চুলোর হাড়িতে চাল চড়বে না এটা হতে পারে না।
সরকারকে আগে ভাবতে হবে কৃষকদের স্বার্থের কথা। এর সাথেই আসবে চাল রফতানির বিষয় ।
—- সুভাষ চৌধুরী , সাতক্ষীরা করেসপন্ডেন্ট , দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি।
চাল রফতানি, কৃষকের লাভ কতটুকু
পূর্ববর্তী পোস্ট