বিদেশের খবর: কাশ্মীর উপত্যকার মুসলমানরা সাধারণত ভেড়া কোরবানি দিয়ে ঈদুল আজহা উদযাপন করে থাকেন। উপত্যকার প্রধান শহর শ্রীনগরে সেনা নজরদারি সত্ত্বেও স্থানীয় বাসিন্দা বশির আহমাদ বরাবরের মতোই ঈদে কোরবানি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন।
কোরবানির পশু কিনতে বাড়ি থেকে বের হন বশির। শ্রীনগর শহরের বাইরে তাঁর বাড়ি। গাড়ি চালিয়ে ২০ কিলোমিটার পথ পার হতে বশিরকে কয়েক দফা সশস্ত্র বাহিনীর দেওয়া ব্যারিকেড এবং রাস্তায় পেতে রাখা কাঁটাতারের বেড়া পার হতে হয়। কিন্তু কোরবানির ভেড়া কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তোলার মতো একটি এটিএম বুথ কিংবা ব্যাংক পাননি বশির আহমাদ। শহরের কোনো এটিএম বুথে নেই অর্থ, ব্যাংকগুলোও বন্ধ। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
পেশায় ব্যবসায়ী বশির আফসোস করে বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় বের হলাম, কিন্তু সবটাই বৃথা।’
গত বছর কোরবানির জন্য পাঁচটি ভেড়া কিনেছিলেন বশির, এবার একটিও কিনতে পারলেন না।
বশির দুঃখ করে বলেন, ‘মনে হয় না এবার একটা ভেড়াও কিনতে পারব। এ বছর কোরবানি দেওয়া হলো না।’
আজ সোমবার মুসলিম-অধ্যুষিত কাশ্মীরে ঈদুল আজহা উদযাপনের দিন। ঠিক এক সপ্তাহ আগে গত সোমবার ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা বাতিল করে ওই অঞ্চলে কারফিউ জারি করে।
কাশ্মীর উপত্যকার মুসলমানরা ভেড়া ও ছাগল কোরবানি দিয়ে ঈদুল আজহা উদযাপন করে থাকেন। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি দিতে। আল্লাহ এর মধ্য দিয়ে তাঁর নবীকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। স্নেহের ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.) ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সবচেয়ে প্রিয়। বাবা হয়ে ছেলেকে কোরবানি দেওয়া অসম্ভব কাজ। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) বিনা দ্বিধায় নিজ ছেলেকে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মহান আল্লাহর নির্দেশে তাঁর ছুরির নিচে হজরত ইসমাইল (আ.)-এর স্থলে কোরবানি হয়ে যায় একটি দুম্বা। স্রষ্টার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য ও ত্যাগ স্বীকারের বাণীই এ ঘটনার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান জিলহজ মাসের ১০ তারিখে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রিয় পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন।
এরপর কোরবানির গোশতের একটি অংশ আত্মীয়স্বজন ও এতিমখানায় পাঠান কাশ্মীরিরা।
কিন্তু এবারের ঈদে সেটা বোধ হয় আর হচ্ছে না। গোটা কাশ্মীরে কয়েক হাজার আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। কড়া নিরাপত্তার বেড়াজালে কাশ্মীর উপত্যকায় যেকোনো বড় জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
গতকাল রোববার কিছু সময়ের জন্য কারফিউ শিথিল করা হলেও সন্ধ্যা থেকে আবার কারফিউ জারি করা হয়। বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, আজ সোমবার ঈদের দিনও কাশ্মীরে কারফিউ বলবৎ থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাকিল ভাট কোরবানির পশু কেনার উদ্দেশ্যে ১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে শ্রীনগরের বাজারে পৌঁছান। কিন্তু বাজারে পৌঁছে দেখেন, ভেড়া-ছাগল যে দামে বিকোচ্ছে, সে দামে কেনার সামর্থ্য নেই তাঁর।
শাকিল বলেন, ‘ভেবেছিলাম নয় হাজার রুপির মধ্যে কোরবানির পশু কিনব, কিন্তু অনেক দাম চাইছেন বিক্রেতারা। তাঁরা বলছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাজারে কোরবানির পশু এনেছেন।’
পশু ব্যবসায়ীরাও ক্রেতাদের মতো হতাশ। কয়েক প্রজন্ম ধরে ঈদে কোরবানির পশু বিক্রি করে আসছেন শমশের খান ও তাঁর দুই ভাই। সারা বছর ভেড়া-ছাগল লালনপালন ও পরিচর্যা করে ঈদের সময় দূরের পার্বত্য এলাকা থেকে শ্রীনগরের বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন তাঁরা।
গত সপ্তাহে কাশ্মীর উপত্যকায় জনসাধারণের চলাফেরায় কড়াকড়ি জারি করার সময়টাতেই রিয়েসি শহর থেকে ১৫০টি ভেড়া নিয়ে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পথ হেঁটে শ্রীনগর পৌঁছান শমশের খান।
খান বলেন, ‘এ বছর কোনো বেচাকেনা নেই। মানুষের কাছে কোনো অর্থ নেই। আর পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে বাড়ি থেকে বলতে গেলে কেউই বের হতে পারছেন না।’
খান আরো বলেন, ‘ঈদুল আজহায় কোরবানির পশু বিক্রি করেই সারা বছরের খোরাকি রোজগার করি আমরা। এটা ছাড়া আমাদের উপার্জনের আর কোনো উৎস নেই।’
কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার ফলে হিমালয়ের এই উপত্যকা জঙ্গিবাদ ও বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগোবে, এমন দাবি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির।
কিন্তু নয়াদিল্লি সরকারের সিদ্ধান্তকে কাশ্মীর উপত্যকায় অযাচিত হস্তক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দা শুজা রাসুল। বত্রিশ বছর ধরে ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি দেওয়া শুজাও এবারের ঈদে অর্থের অভাবে কোরবানির পশু কিনতে পারেননি।
শুজা রাসুল বলেন, ‘আমরা স্বাধীন নই। আমাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের স্বাধীনতা নেই। ভীষণ খারাপ লাগছে আমার।’
পনেরো বছর ধরে পশু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এক ব্যবসায়ী জানালেন প্রতিশোধ নেওয়ার কথা। ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘(নরেন্দ্র) মোদি এখানকার পরিস্থিতি কতটা খারাপ করে রেখেছেন, তা চিন্তার বাইরে। তিনি কারফিউটা তুলে দিলেই নিজেদের জীবন বিসর্জন দেব আমরা। যেভাবে ঈদে ছাগল কোরবানি দিই, ঠিক সেভাবে আমাদের জাতির জন্য নিজেদের প্রাণ দিয়ে দেব।’