মো. বশির আহমেদ: কালিগঞ্জের নলতায় ৯, ১০ ও ১১ ফেব্রুয়ারী ৫৬ তম ওরছ শরীফে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক সফল স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আ.ফ.ম. রুহুল হক এমপি সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক ও সমাজহিতৈষী ছিলেন।
সাতক্ষীরা জেলার (তদানীন্তন খুলনা জেলা) নলতা শরীফে ১৮৭৩ সালে ২৬ ডিসেম্বর মাসের শনিবার প্রত্যুষে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মুন্সী মোহাম্মদ মুফিজ উদ্দীন একজন ধার্মিক, ঐশ্বর্যবান ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তার মায়ের নাম মোছাঃ আমিনা বেগম।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ ছিলেন পিতামহের একমাত্র পুত্রের জ্যেষ্ঠ সন্তান। ফলে তার শিক্ষার জন্য পিতা ও পিতামহের আপ্রাণ চেষ্টা ও আগ্রহ ছিল। তার বয়স পাঁচ বৎসর পূর্ণ না হতেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৮৮১ সালে তিনি ‘গ-মিতিয়’ (বর্তমান দ্বিতীয় শ্রেণীর সমমান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একটি রূপার মুদ্রা পুরষ্কার পান। তিনি নলতার মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় হতে ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ ভাগ অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি টাকী গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে চতুর্থ (বর্তমান সপ্তম) শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৮৮ সালের শেষভাগে কলকাতায় লন্ডন মিশন সোসাইটি ইন্সটিটিউশনে সেকেন্ড ক্লাসে (বর্তমানে নবম শ্রেণী) ভর্তি হন এবং এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ১৮৯০ সালে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রান্স (বর্তমানে এস,এস,সি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও বৃত্তি লাভ করেন। তিনি হুগলী কলেজ থেকে ১৮৯২ সালে এফ.এ (বর্তমানে এইচ.এস.সি) এবং ১৮৯৪ সালে কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে সাফল্যের সাথে বি.এ. পাশ করেন। ১৮৯৫ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রপিতামহীর ইচ্ছানুসারে ফয়জুননেছা মহারানির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু সংসার জীবন শুরু করেন সরকারী চাকুরিতে প্রবেশের পর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক কন্যা যিনি শৈশবে মারা যান ও আট পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। পুত্রগন যথাক্রমে- ব্যারিস্টার মোঃ সামছুর জোহা, মোঃ বদরুজ্জা, মোঃ নুরুল হুদা, মোঃ নাজমুল উলা, মোঃ জয়নুল ওয়ারা, মোঃ কামরুল হুদা, মোঃ মাজহারসু ছাফা ও মোঃ গাওছার রেজা।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ ১ আগস্ট, ১৮৯৬ তারিখে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ‘সুপার নিউমারারি’ টিচার হিসেবে যোগদান করেন। তিনি অক্টোবর ১৮৯৬ থেকে মার্চ ১৮৯৭ পর্যন্ত ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ী মহকুমার স্কুল সাবইন্সপেক্টর পদে কর্মরত ছিলেন। ১৮৯৭ সালের ১ এপ্রিল তিনি ফরিদপুর জেলার অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক বৎসরের মধ্যেই তিনি পদোন্নতি পান বাকেরগঞ্জ উপজেলার ডেপুটি ইন্সপেক্টর পদে। একাধিক্রমে ৭ বৎসর তিনি বরিশালে অবস্থান করেন। ১৯০৪ সালে তিনি Subordinate Educational Service তিনি Provincial Educational Service এ প্রবেশ করেন। তিনিই প্রথম Inspecting Line থেকে Teaching Line এর জন্য মনোনীত হন। ১৯০৭ সালে তিনি চট্টগ্রামের ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত হন। ১ এপ্রিল, ১৯১২ সালে প্রেসিডেন্সী ডিভিশনের Additional Inspector পদে নিযুক্ত হন। ১৯১৯ সালে তিনি আবার চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় ইন্সপেক্টর পদে বদলী হন। ১ জুলাই ১৯২৪ তারিখে তিনি Assistant Director of Public Instruction for Muhammadan পদে নিযুক্ত হন। পাঁচ বৎসর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ এর দীর্ঘ চাকরি জীবনের সম্পূর্ণটাই কেটেছে শিক্ষা বিভাগে। তার এই দীর্ঘ সময়ের দিনগুলি ছিল বর্ণাঢ্য, পরিশ্রম ও সাফল্যের সমাহার। একজন সাধারণ শিক্ষক থেকে শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদে আসন গ্রহণ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠার এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ছিল সত্যিই অনন্য। অফিসের প্রতিটি দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পাদনা করাকে তিনি ধর্ম পালনের অংশ হিসেবে মনে করতেন। তিনি যখন যেখানে যে দায়িত্বে থাকতেন সে অঞ্চলের শিক্ষা প্রসারের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতেন। পাশাপাশি সমাজ সংস্কার তথা সমাজের সার্বিক উন্নয়নের প্রতিও তিনি ছিলেন সচেষ্ট। আধ্যাত্মচর্চা ও আধ্যাত্মিক জীবন যাপনের প্রতি বাল্যকাল থেকেই তার প্রবল আকর্ষণ লক্ষণীয়। তিনি রাজবাড়ীর অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর থাকাকালীন পায়ে হেঁটে মফস্বলে স্কুল পরিদর্শন করতেন। কখনো কখনো তাকে রমজান মাসে ২০ মাইল পর্যন্ত হাঁটতে হছে। তিনি রাজশাহীতে অবস্থান কালে মুছলমান ছাত্রদের শিক্ষার প্রয়োাজনীয় সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করেন। তিনি নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে সংগ্রামের মাধ্যমে মুছলমান ছাত্রদের জন্য দ্বিতল ছাত্রাবাস ‘ফুলার হোস্টেল’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ এর চাকরি জীবনের একটা বড় অধ্যায় কেটেছে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় ইন্সপেক্টর হিসেবে। চট্টগ্রামের দায়িত্বভার গ্রহণ করার কিছু দিনের মধ্যেই বিভাগীয় কমিশনারের প্রস্তাব অনুসারে সদরের সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোর আবশ্যকতা অনুযায়ী স্থান পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন সেই কমিটির সেক্রেটারি। এক বৎসরের বেশি সময় ধরে কাজ করে তিনি কমিটির রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। বিভাগীয় কমিশনার তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বেতন বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব করেন। তার পদের গুরুত্ব বিবেচনা করে মধ্যবর্তী দু’টি গ্রেড অতিক্রম করে বেতন ২৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায় উন্নীত হয়। চট্টগ্রাম বিভাগের শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট ও আন্তরিক। কর্তৃপক্ষও ছিল তার প্রতি আস্থাশীল। এসময় চট্টগ্রাম বিভাগে যে অর্থ ব্যয় হত অন্য সব বিভাগে একত্রে সে অর্থ ব্যয় হত না। তার প্রচেষ্টার ফলে চট্টগ্রাম বিভাগে শিক্ষার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর পরিদর্শন বিভাগে দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে এডুকেশন প্রসিডিং এ উল্লেখ করা হয়ঃ “The work of the inspectorate Particularly of the Divisonal inspectorate is not satisfactory. The branches of the service requires radical improvement in both ogranisation and efficiency. During the last year the inspectorate lost the services of two exprience officers Mr. Stapleton and Khan Bahadur Moulovi Ahsanullah.”
মহামনীষী খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ এর শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তি বাংলার মুছলিম ইতিহাসে এক নতুন মাইল ফলক। এই দায়িত্ব প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে মুসলিম শিক্ষার উন্নতি ও প্রসারের গুরুদায়িত্ব¡ তার উপর অর্পিত হয়। তিনিও তার মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা ও অনাগ্রহ দূরীকরণে এবং অগ্রগতি সাধনের অনুকূলে উচ্চ পর্যায়ে নীতি নির্ধারণে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। নতুন দায়িত্বে যোগদানের পরপরই তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত স্ক্রীমসমূহ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কলকাতার মুসলিম ছাত্রদের জন্য একটি স্বতন্ত্র কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিয়া কলেজ। ইসলামিয়া কলেজ ছাডাও তিনি বহু স্কুল, কলেজ ও হোস্টেল প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নের সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তারই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল। ১৯২৮ সালে মোছলেম এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অবদান প্রশংসনীয়। এছাড়াও তার প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোর মধ্যে রয়েছে মুসলিম হাইস্কুল, চট্টগ্রাম (১৯০৯), মাধবপুর শেখ হাই স্কুল, কুমিল্লা (১৯১১), রায়পুর কে.সি হাই স্কুল (১৯১২), চান্দিনা পাইলট হাই স্কুল, কুমিল্লা (১৯১৬), কুটি অটল বিহারী হাই স্কুল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া (১৯২০), চন্দনা কে.বি হাই স্কুল, কুমিল্লা (১৯২০), চৌদ্দগ্রাম এইচ.জে পাইলট হাই স্কুল (১৯২১) উল্লেখযোগ্য।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীর নাম লেখার রীতি প্রচলিত ছিল। অনেকের মতে সাম্প্রদায়িকতা বিদ্যমান থাকায় হিন্দু ও মুসলিম পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব হত। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা- এর প্রচেষ্টায় প্রথমে অনার্স ও এম.এ পরীক্ষার খাতায় নামের পরিবর্তে ক্রমিক নং (জড়ষষ ঘড়.) লেখার রীতি প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীতে এই.এ এবং বি.এ পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীর নাম লেখার রীতি রহিত করা হয়।
সে সময় হাই স্কুল ও Intermediate মাদ্রাসা থেকে পাশ করে ছাত্ররা কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেত না। উক্ত মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়ন করেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা। ফলে মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্রদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
তৎকালীন সব স্কুল কলেজে তিনি মৌলবির পদ সৃষ্টি করেন এবং পণ্ডিত ও মৌলবির বেতনের বৈষম্য রহিত করেন।
তখন উর্দুকে Classical Language হিসাবে গণ্য করা হত না। ফলে পশ্চিম বঙ্গের উর্দু ভাষী ছাত্রদের অসুবিধা হত। তারই প্রচেষ্টায় উর্দু সংস্কৃতির স্থান অধিকার করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার খসড়া বিল সিনেটে উপস্থাপিত হলে দারুণ বিরোধ সৃষ্টি হয়। পরে তা বিবেচনার জন্য একটি স্পেশাল কমিটি গঠিত হয়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা উক্ত কমিটির একজন সদস্য ছিলেন এবং তিনি এর আবশ্যকতা সমর্থন করেন।
সরকার মুছলিম শিক্ষার ভার খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা এর হাতে ন্যস্ত করেন। ফলে বহু মক্তব, মাদ্রাসা, মুসলিম হাইস্কুল এবং কলেজ তারই তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও অমুসলিম স্কুলে মুসলিম শিক্ষকের নিযুক্তি এবং অন্যান্য সরকারি বিভাগের মুসলিম কর্মচারী নিযয়োগও তার হাতেই ন্যস্ত ছিল।
এই সুযোগে তিনি স্বতন্ত্র মক্তব পাঠ্য নির্বাচন ও মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য একমাত্র মুসলিম লেখকের প্রণীত পুস্তক প্রচলনের নিয়ম প্রবর্তন করেন এবং সরকারের অনুমতি নেন। প্রত্যেক মুসলিম বিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয় এবং প্রত্যেকের জন্য মুসলিম রচিত পাঠ্য পুস্তকের ব্যবহার প্রচলন হয়। এ সময় মখদুমী লাইব্রেরী, প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরি ও পরে ইসলামিয়া লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
মুসলিম ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ধারা নির্দিষ্ট হয়। বিদ্যালয়ের সকল শ্রেণীর বৃত্তি বণ্টনের পূর্বে তার মতামত গ্রহণ করা হত।
মুসলিম লেখকদের পাঠ্যপুস্তক লেখার সুযোগ দেওয়া হত। পূর্বে যে সকল লেখক ও পুস্তক ঘৃণিত বলে বিবেচিত হয় সরকারি ব্যবস্থায় তা সমাদৃত হতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে পুস্তক প্রকাশনা ও লেখদের অবস্থা আশাতীত উন্নতি লাভ করে।
মুসলিম ছাত্রদের জন্য বেকার হোস্টেল, টেলার হোস্টেল, কারমাইকেল হোস্টেল ও মুছলেম ইন্সটিটিউট কলকাতার বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম সাহিত্যের বিপুল প্রসার লাভ করে। মুছলিম সাহিত্যিকগণ নতুন প্রেরণা পান। বৈদেশিক শিক্ষার জন্য মুসলিম ছাত্র ছাত্রীদের সরকারি সাহায্য প্রদানের নিয়ম নির্ধারিত হয়। টেক্সটবুক কমিটিতে মুসলিম সদস্য নিযুক্ত হয়, মুসলিম পাঠ্যে ইসলামী শব্দ প্রয়োগ হতে থাকে। মুসলিম মহিলাদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশেষ বিশেষ স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুছলিম শিক্ষা ও সাহিত্য বিস্তারে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা এর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ‘মখদুমী লাইব্রেরী ও আহ্ছানউল্লা বুক হাউজ লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা। মখদুমী লাইব্রেরীর উৎসাহ ও উদ্দীপনায় অনেক মুছলমান লেখক সৃজনশীল লেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। বহু সাহিত্যিক, লেখক, কবি এই লাইব্রেরীর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পরে। তৎকালীন আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ আনোয়ারা ও বিষাদ সিন্ধু এই লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও এই লাইব্রেরি থেকে কাজী নজরুল ইসলামের ‘জুলফিকার’, বনগীতি, কাব্য আমপারা’, খ্যাতনামা কথা শিল্পী আবু জাফর শামসুদ্দিনের ‘পরিত্যক্ত স্বামী’ , সৈয়দ আলী আহছানের ‘নজরুল ইসলাম’, শেখ হাবিবুর রহমানের ‘বাঁশরী’, ‘নিয়ামত’ প্রভৃতি বই প্রকাশিত হয়। এই লাইব্রেরি থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীর বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। শুধু তাই নয় অনেক নতুন লেখকদের লেখা গ্রন্থও এখান থেকে প্রকাশিত হয়। মখদুমী লাইব্রেরীর কার্যক্রম তৎকালীন মুছলিম সমাজে সাহিত্য সৃষ্টি ও সাহিত্যের প্রসারের ক্ষেত্রে একটি দ্রুত ও মৌলিক পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়েছিল।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা তার কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার স্বীকৃতি অল্প সময়ের মধ্যেই অর্জন করেন। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তাকে ‘খানবাহাদুর’ উপাধি প্রদান করা হয়। তিনি চাকরিতে প্রবেশের মাত্র ১৫ বৎসরের মধ্যে এই সাফল্য অর্জন করেন। ১৯১১ সালে তিনি Royal society for the encouragement of arts, manufactures & commerce এর সদস্য পদ লাভ করেন। তিনি ১৯১৯ সালে ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস (I.E.S) ভুক্ত হন। মুছলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম (I.E.S) ভুক্ত হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এক দশকেরও বেশি সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোটের (বর্তমান সিনেট) মেম্বার ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি লগ্নে ডঃ নাথান সাহেবের অধীনে Teaching কমিটির মেম্বার ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট ও বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলা একাডেমী তাকে ১৯৬০ সালে সম্মানসূচক ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করেন। সমাজ সেবা ও সমাজ সংস্কৃতিতে বিশেষ করে দীন প্রচারের কাজে অবদানের জন্য ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাকে ১৪০৪ হি: তে মরণোত্তর পুরষ্কারে ভূষিত করে।
তিনি ৯ ফেব্র“য়ারি ১৯৬৫ সালে ৯০ বছর বয়সে নলতা শরীফে শাহাদাৎ বরণ করেন।
তিনি তার জীবদ্দশার আহছানীয়া মিশন নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেন। যার উদ্দেশ্য হলো স্রষ্টার এবাদত এবং সৃষ্টির সেবা। তার নিজ গ্রাম নলতা শরীফে সমধিস্থ করা হয় এবং পাক রওজা শরীফটি ইতিমধ্যে একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসাবে সকলের কাজে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতি বছর ৮,৯,১০ ফেব্রয়ারী তার স্মরণার্থে ওরজ শরীফ উদযাপন করা হয়। দেশ-বিদেশ থেকে তার অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগীরা প্রতিদিন তার রওজা শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে নলতা শরীফে আসেন।