বঙ্গবন্ধুর ডাকে ২ মার্চ শুরু হয়েছে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন। চলছে হরতাল । তখন দেশ চলছে বঙ্গবন্ধুর কথায়, এমন একটি পরিস্থিতিতেও ধর্মঘট চালাকালে খোলা থাকছে ব্যাংক। কারণ বঙ্গবন্ধু জানিয়েছেন তারা যেনো বেতন তুলতে না পেরে কষ্ট না পায়।
১৯৭১ এর ৭ মার্চ তৎকালিন রেস কোর্স ময়দানে ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর তীর্যক তীক্ষè জ¦ালাময়ী ভাষন জাতিকে দিয়েছিল দিক নির্দেশনা । বাঙ্গালি জাতির ওপর বঙ্গবন্ধুর আস্থা আর তার নেতৃত্বের প্রতি জনগনের আস্থা ছিল বিতর্কহীন। আর একারণে সেদিন লন্ডন টাইমস লিখেছিল বঙ্গবন্ধু কার্যতঃ বাংলাদেশের ডি ফ্যাকটো (ফব ভধপঃড়)। অনেকে মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধুর এই ভাষন ছিল ১৮৬৩ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেসের মতো। আব্রাহাম লিংকন তার তিন মিনিটের ভাষনে বলেছিলেন দ্য গভর্নমেন্ট বাই দ্য পিপল, অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল(ঞযব এড়াবৎহসবহঃ নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব) । আর বঙ্গবন্ধু তার ১৮ মিনিটের ভাষণে বলেছিলেন ‘ তোমরা আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’। কি অদ্ভুত মিল ।
আমি তখন খুলনার দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজের ( বিএল কলেজ) ্ ছাত্র। ঢাকার হাঙ্গামার কথা বারবারই আমাদের কানে আসছিল । পাক হানাদাররা টঙ্গি খুলনাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বহু গুরুত্বপূর্ন স্থানে গুলি চালিয়েছে। সবখানেই ছাত্র জনতার তোপের মুখে পড়েছে তারা। এক দারুন উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে কাটছিল আমাদের সময়। কি করতে হবে, কিভাবে আমরাও প্রতিরোধের বারুদ ছিটাবো তার কিছুই আমাদের জানা নেই। প্রগতিশীল ছাত্র হিসাবে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারি না। তাই নেতৃত্ব আর নির্দেশের অপক্ষোয় ছিলাম আমরা। ফুসে উঠি মাঝে মধ্যে। খুলনা অঞ্চলের কলেজগুলিতে নেমে আসে গগন বিদারী স্লোগানের শব্দ। বারবার কেঁপে ওঠে ওই জনপদ। শ্রমিক পাড়া ছাত্র পাড়া ফুসলে ওঠে নির্দেশ চাই। ৬ মার্চ পাক সামরিক জান্তা ইয়াহিয়ার ভাষন। জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। আমরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠলাম বঙ্গবন্ধু কোথায়। কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন তিনি। কেনো তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন না। বাঙ্গালিরা কি তবে ক্ষমতা পাবেনা। পাক বাহিনীর বুলেটে কি আমরা মরতেই থাকবো। মার্চের ২ , ৩, ৪, ৫ ও ৬ এভাবেই উৎকন্ঠার মধ্যে কেটে গেলো। হোস্টেলে মেসে শ্রমিক এলাকায় চায়ের দোকান ক্লাব মহল্লায় খেলার মাঠে সবখানে একই কথা। জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি ঘৃণা বাড়তেই থাকলো আমাদের।
এরপর ৭ মার্চ । মনে হলো বহুদিন পর দিনটির আগমন। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান সত্যিই পরিনত হয়েছিল এক জনসমুদ্রে। দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বিএল কলেজের অধ্যাপক আবু সুফিয়ানসহ আমাদের কয়েকজন শিক্ষক ওই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন। তারাই আমাদের শোনালেন হিমালয় প্রমান বিশাল মানুষটির বজ্রকন্ঠের কথা। পরদিন ৮ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর সেই পাথর খোদাই ভাষন দেখলাম ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তানের পাতায় ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম ,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ । বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষন কানে বাজতেই আমার বুকে ঝিলিক দিলো। তাজা রক্ত চাঞ্চল্যে উদ্বেলিত হয়ে উঠলাম আমরা। বিএল কলেজ থেকেই আমরা বের করলাম এক বিশাল মিছিল। আমাদের মিছিলে যোগ দিলেন আমজনতা, শ্রমিক, কৃষক,পথচারি, দোকান মালিক। আমরা আকাশ ফাঁটানো স্লোগানে মানুষকে জাগরিত করে তুলেছিলাম। আর সকলেই সুর মিলালাম হাজার বছরের ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ‘ রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো’। মহামুক্তির লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়া বীর বাঙ্গালি বুকের রক্ত দিয়ে সত্যিই ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার লাল সূর্য। সবুজ চত্বরে লাল সূর্যের গোলাকার অবয়ব খচিত জাতীয় পতাকা এখন আমার হৃদয়ে।
এরই মধ্যে কেটে গেছে প্রায় অর্ধ শতাব্দি। রক্তের মধ্যে অর্জিত যে বাংলাদেশ , অগনিত মা ও বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা, লক্ষ প্রাণের আত্মাহুতির শির উঁচু করে দন্ডায়মান যে স্মৃতিসৌধ, আমার হৃদয় মন্দিরে উৎকীর্ণ যে মুক্তিযুদ্ধ, কি তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট , আজকের প্রজন্ম সে সম্পর্কে কতোটুকু অবহিত তা খতিয়ে দেখা দরকার। রাক্ষস পলাশি প্রান্তরের ১৭৫৭ এর ২৩ জুন ট্রাজেডির পর বাঙ্গালি জাতির মুক্তি সনদ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন জাতিকে। আত্মত্যাগের বিনিময়ে আকাশে উদিত রক্তলাল সূর্য। এই ইতিহাস কি কখনও বিস্মৃত হতে পারে। নতুন প্রজন্মের সামনে সে ইতিহাস উন্মোচন করতে হবে। ইতিহাসের সেই যাদুঘরে আজকের শিশুর চোখ খুলে দিতে হবে।
১৯৫ টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ্এই ঐতিহাসিক ভাষনকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসাবে রেকর্ডভূক্ত করেছে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্লড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’। বঙ্গবন্ধুর জ¦ালাময়ী ভাষনের মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ইয়াহিয়া বাহিনী বাঙ্গালি নিধন শুরু করতেই বঙ্গবন্ধু শার্দুলের মতো গর্জে উঠে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সেই একই রেসকোর্স ময়দানে পাক হানাদার বাহিনী বাঙ্গালি জাতির সম্মোহনী শক্তির কাছে হার মেনে মাথা নিচু করে আত্মসমর্পন করে।
স্মৃতির ধুলোবালির তলে তলিয়ে যায়না যে কন্ঠ, বিস্মৃতির জটলায় হারায়না যে বাণী, হৃদয় পুস্তক থেকে মুছে যায়না যে ইতিহাস , মুকুটহীন সেই স¤্রাট গণমিছিলের কান্ডারি শতাব্দির সেই মহনায়ক বাঙ্গালি জাতির মুক্তি সনদ, শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ৭ মার্চের বজ্রকন্ঠ আজও আমার হৃদয়ের রক্ত দোলায়্ , স্মৃতিতে ভাস্বর। যে স্মৃতি আজও আমাকে আন্দোলিত করে, যে স্মৃতি আজও আমার স্বাধীনতার প্রাণশক্তি যোগায় , যে শক্তি আজও আমাকে প্রতিবাদ মিছিলে ঠেলে দেয়।
মহাকালের ইতিহাস। মহাকালের বৃন্তে প্রস্ফুটিত পুষ্প বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এমনই একটি নিষ্পাপ পুষ্প যার পাপড়ি ঝরে না কোনোদিন। যার বৃন্ত বাতাসে দুমড়ায়না। তর্জনী উচিয়ে এক গাল হাসির ফোয়ারা নিয়ে পূর্ণ এ পুষ্প। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উত্থিত এই একটি নাম বাংলাদেশের মাটি ফুঁড়ে মাথা উঁচু করা সে এক মহীরুহের অবয়ব, ফুলের বাগানে সর্বোচ্চ শির নিয়ে দন্ডায়মান সেতো জাতির জনক, সেতো বঙ্গবন্ধু, সেতো শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি ৭ মাচের্র মহাকাব্য।
– সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেড থেকে সুভাষ চৌধুরী ০৬.০৩.২০ রাত ১০ টা।
পূর্ববর্তী পোস্ট