দুর্যোগ চিরকাল থাকে না। আবার সুসময়ও চিরকাল বয় না। একটা আরেকটার পিছে চলে। প্রকৃতির ইতিহাস তেমনই বলে। প্লেগ, কুষ্ঠ, বসন্ত, পোলিও’র মহামারি যেমন এসেছে, তেমন সেগুলোর প্রতিষেধকও এসেছে। শুধু চাই হুঁশ। কিছু মানুষের হুঁশ ছিল বলেই, ওই সব মহামারি কাটানো গেছে। আজ করোনা ভাইরাসের দুর্যোগ চলছে। সংক্রমণ ঠেকাতে আপনাকে যে ঘরে থাকতে বলছে, সেটাও ওই হুঁশ। আপনার নিঃসঙ্গতা, হাজার মানুষকে ভাইরাস থেকে নিঃসঙ্গ করবে। আপনার খারাপ লাগছে, কিন্তু আপনার ওই খারাপের মধ্যে যেটা আছে, সেটাই এখন আমাদের ভালোলাগা। আপনার কষ্টকর ঘরবন্দি অবস্থা করোনা ভাইরাস রুখতে স্বস্তিকর আবহ দেবে। আপনার নিঃসঙ্গতা তাই ্একটি ওষুধ, অন্ততঃ যতক্ষণ না দৃশ্যমান ওষুধ আসছে। রাস্তাঘাটে, জামাকাপড়ে, গাড়িঘোড়ার ছিটেÑহাতলে, পাত্রে-ব্যবহার্যে, ্ইট-মাটি-বসার স্থানে ঘাপটি মেরে আছে ওই করোনা ভাইরাস। নিজের এত প্রতিলিপি ঘটাচ্ছে কী করে সে? জেনেটিক মিউটেশন ঘটিয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখছে সে। এত দ্রুত জিন পরিবর্তন করছে কী করে সে? পুরো মানব সভ্যতা থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছে তাই। এমন ভাবনাই মানব সভ্যতার যাত্রাপথের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশ^াস-মুল্যবোধে পরিবর্তন আনে। চতুর্দশ শতকে ব্ল্যাক ডেথের ( যে মহামরিতে ইউরোপে দুই তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গিয়েছিল) সময় ই্উরোপ জুড়ে একটা পরিবর্তন আসে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পথ খুঁজতে শুরু করে মানুষ। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় নতুন বিশ^াস আসে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা ধর্মবিশ^াসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে অনুসন্ধিৎসার যুগে প্রবেশ করে মানুষ। যাকে আমরা রেনেসাঁ বলি। শেষ হয় মধ্যযুগ। সূচনা হয় শিল্প যুগের। তার প্রভাব সমগ্র পৃথিবীজুড়ে। একটা কথা ্এখানে বলা দরকার। ব্লাক ডেথের পর ইউরোপের আবহাওয়া হঠাৎ ভালো হয়ে ওঠে। প্রচুর ফসল হয়। মানুষ যা কল্পনাই করতে পারেনি। কারণ ফসলের অভাবে ১৩১৩ সালে সেখানে মহা-দুর্ভিক্ষ নেমে ্এসেছিল।…এ কি প্রকৃতির খেলা? আমি বলব তাই। করোনা জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন রুপে এসেছে। নভেল করোনা ভ্ইারাস তাই নতুন করোনা ভাইরাস। পুরনোর নতুন রুপ। ২০০০ সালে সার্স ভাইরাস রুপে সে প্রথম দেখা দেয়। তাই তার এই নতুন রূপে প্রত্যাবর্তন আরেকটি বার্তা দেয় ; প্রতিষেধক এলেও জেনেটিক মিউটেশন ঘটিয়ে সে আবার ভিন্ন রুপে আসবে। হয়ত দেরি হবে। কিন্তু আসবে। এখন আমি যদি, এ নিয়ে একটি সায়েন্স ফিকশন লিখি, এবং সেখানে একটি ভাইরাসের নাম দিই ‘মস্কো-২৭’, তাহলে আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। মঙ্গলে যে রোবট গেছে, সেটা কিন্তু ‘আরএনএ’ও খুঁজছে। জীবের উদ্ভব নিয়ে গবেষণা করছেন যারা, তারা একমত যে, আরএনএ’ এবং ‘ডিএনএ’ই জীবকোষের মূল। তারা এ বিষয়েও একমত যে, এই আরএনএ বহির্জগত থেকে এসেছে। ্এমন যে, কোন গ্রহাণু পৃথিবীর বুকে ছেড়ে দিয়ে গেছে। পৃথিবীকে জীবময় রাখতে। ২০০০ সালে জন্ম, ২০১৫তে থেমে গেল, ২০১৯ ্এ জেগে উঠল। ২০১৫ থেকে ২০১৯ মাত্র ৪ বছর। এই ৪ বছরে নতুনরুপ নিল কী করে নভেল করোনা ভাইরাস? আচ্ছা সেটা বাদ দিলাম। বিজ্ঞানীরা বলছেন-করোনা গোত্রের এই নভেল-করোনা প্রাণীদেহ থেকে এসেছে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে চিনের উহানে ্একটি কাঁচাবাজারে কোনো সামুদ্রিক প্রাণী থেকে তা মানব দেহে সংক্রমিত হয়েছে। তাহলে কথা আছে। প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহের জিনে ঢুকল। সময় মোটে কয়েকটা দিন বা মাস। মানুষের জ্ঞানের ইতিহাসে এতদ্রুত ভিন প্রজাতির জিনে মিলিত হওয়ার উদাহরণ নেই। যেভাবেই হোক, সময়ের নিরিখে এটা হতে গেলে যে শক্তি দরকার, এই ভাইরাস তা পেলো কীভাবে? এর উত্তর ভবিষ্যতে যদি কেউ এভাবে দেয় যে, ২০১৭ সালে সৌরজগতের বুক দাপিয়ে চকিতে চলে গিয়েছিল যে মহাজাগতিক বডি, সেই ছড়িয়ে দিয়েছে এর শক্তি, তাতে আমি আশ্চর্য হব না। সৌরজগতের বাইরে থেকে এসেছিল সেটা। কোথায় যে হারিয়ে গেল, আর দেখা যায়নি। আমরা তার নাম দিয়েছি ‘ওউমুয়ামুয়া’, একটা গ্রহাণু। কিছুদিন আগে আমাজন পুড়ল। পুড়ল অষ্ট্রেলিয়ার জঙ্গল। কোটি প্রজাতি পুড়ে ছাই হল। অপ্রয়োজনীয় বলে কী পুড়িয়ে দিল প্রকৃতি? কীকরে বলব? হয়ত ভবিষ্যতে কোনো এক বৃষ্টির দিনে কলা গাছের গোড়ায় নতুন এক প্রাণি দেখলেন। ছবি তুলে ছেড়ে দিলেন ইন্টারনেটে। কেউ সেটাকে চিনল না। জীব বিজ্ঞানীরা সেটাকে নতুন প্রজাতির প্রাণি বলে দাবি করলেন। কে জানে সেই নতুন প্রাণিটির উদ্ভবের জন্য প্রকৃতিতে প্রাকৃতিক রতি-সঙ্গম ঘটেছিল এই করোনা ভাইরাসের দ্বারা। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের শক্ত দিন অপেক্ষা করছে। বিজ্ঞানীরা এমনটা বলছেন। সেই শক্ত দিনে, আমাদেরকে শক্ত করার জন্য একটা প্রস্তুতিও হয়তো নেওয়া হয়েছে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, ব্øাক ডেথের পর মানুষের জীবনী শক্তি বেড়ে গেছে। ভাইরাস আক্রান্ত কোষগুলো সেরে উঠে অধিকমাত্রায় সহনীয় হয়েছে। তাই বলব, সবকিছুর মধ্যে কিছু না কিছু সত্য আছে। করোনা নিয়ে যে যেভাবে বলছে, কিছু না কিছু সত্য রয়েছে। সত্য একটা মালা। সেই মালা গাঁথা হয়েছে যে ফুলে, তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানান কথায়, নানান বিশ^াসে। সেগুলোকে সঠিকভাবে চয়নকরে একজায়গায় রাখলে, সেই পুর্ণাঙ্গ মালা পাওয়া যাবে। কিন্তু সেগুলোকে চয়ন করে একত্রে রাখার মত শক্তি আমাদের কতটুকু? তাই কারো কথাকে আমি হেলা-ফেলা করি না। এই হুঁশ আমার আজকের। আমাদের এই পৃথিবীও কোয়ারেন্টিনে আছে। গ্যালাক্সির এমন জায়গায় এর অবস্থান, মহাজাগতিক হইহুল্লোড় এড়িয়ে থাকা যায়। এ থেকে শেষতক আমি ভাবি, মানুষ অপার কৃপা পাবে। মানুষসুদ্ধ এই পৃথিবী হচ্ছে সেই আয়না, যাতে সমস্ত বিশ^গজত নিজের রুপ দেখে। এত সুন্দর স্বরুপ দেখানো আয়না, সহজেই ভেস্তে যেতে পারে না। তাই আস্থা রাখি, বিশ^াস রাখি-মানুষই জিতে যাবে। ্এই ভাইরাস সাময়িক। শুধু হুঁশ রাখতে হবে।
আমি আজ ঘরবন্দি। একটু ফুরসৎ জুটেছে। এমন দিনে আমার আরেকটি হুঁশ হয়েছে। আজ ২৬ মার্চ। হ্যাঁ, আমাদের স্বাধীনতা দিবস। অবস্থা বুঝে শুধু জাতীয় পতাকা তুলে আমাদের পালন করতে হচ্ছে। সেটা যথোচিত। কিন্তু আরেকটি ঘটনা রয়েছে। আজ সেটাই আমার শেষতক হুঁশ। আজ লেখক ছড়াকার আহমেদ সাব্বিরের জন্মদিন। আহমেদ সাব্বির সম্প্রতি তাঁর ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ঘরবন্দি থাকার এই দিনগুলিতে শিশুদের প্রতি করণীয় বিষয়ে। ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণের সময়ে শিশুদের প্রতি দুর্যোগ নেমে এসেছিল আফ্রিকায়। আমাদের দেশে তেমন ঘটুক- তিনি চান না। কারণ শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যতকে বয়ে বেড়াবে। নিজের দয়িত্ববোধ থেকে তাই তিনি কিছু করণীয় ঠিক করে দিয়েছেন। সেগুলো খুবই দরকারি বলে আমি মনে করি। তিনি ইতিমধ্যে দেশে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে আখ্যা পেয়েছেন। অগ্রণীব্যাংক-শিশু একাডেমি পুরষ্কারও জিতেছেন। তাই শিশুদের নিয়ে লিখতে হবে, তা নয়। ওই লেখায় তাঁর সংকট ভাবনার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে নিবেদিতা-তেরেসা-নাইট এঙ্গেলদের মানবিক শক্তির দ্যুতি কিছুটা হলেও আবার দেখতে পেয়েছি। করোনাক্রান্ত এই সময় তাঁকেও শান্তিতে রাখেনি।
সাব্বির ভাই আমার প্রিয়জন। আমরা প্রায়ই একসাথে থাকি। যেটুকু সময় একসাথে থাকি লেখালেখি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু এ কদিন আলোচনার বিষয় শুধুই করোনা। করোনা সতর্কতা নিয়ে তিনি অনেক ছড়া লিখেছেন। লিখেছেন শ্লোগান। আমাকে দেখিয়েছেন। সেগুলো যথার্থ, এতটাই ছন্দবহুল যে, নিমেষেই বুড়ো-বাচ্চাদের মনে গেঁধে থাকবে। দু’একটার উদাহরণ না দিয়ে পারছি না ঃ
#
বিদেশ থেকে আসল কুটুম
বসল সোনার খাটে
কাশতে কাশতে কুটুম গেল
রতনপুরের হাটে।
হাটের ভিড়ে হাঁচ্চি দিল
সবজিতে আর মাছে
রাত্রিবেলা কুটুম খতম
করোনা ভাইরাসে।
মর মর হাজার খানেক
রতনপুর হাটের
ভাবছে তারা কোথায় ছিল
আত্মীয় বজ্জাতের।
#
ভ্যাকসিন নাই
নাই টেস্ট কিট
মৃত্যুর মুখে
বাঁধবে কে গিট
এই সংকটে
কতিপয় চিট
চাল ডাল নুনে
করছে প্রফিট।।
#
আতঙ্ক নয়, সতর্ক হোন
মানলে নিয়ম বাঁচবে জীবন
চৌদ্দ দিনের করেন্টিন
করোনা কে বিদায় দিন।
তিনি বলেন, ‘আমার আর কী করার আছে, এই দূর্যোগে তো মুখ বুজে বসে থাকতে পারি না।’ ্এখানে একটা কথা বলা দরকার, সাতক্ষীরায় আমরা আমাদের পরিচিতজনদের জন্মদিন পালন করি। এর উদ্যোক্তা কবি ও সম্পাদক স ম তুহিন ভাই। একে একে সেই উদ্যোগে সামিল হয়েছেন কবি ও ছড়াকার নুরুজ্জামান সাহেব, সায়েম ফেরদৌস মিতুল, ডেইলি সাতক্ষীরার সম্পাদক হাফিজুর রহমান মাসুম ভাই, কবি শুভ্র আহমেদ, মর্ণিং সান প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আমিনুর রহমান কাজল প্রমুখ। সাব্বির ভাইয়ের লেখনি নিয়ে আলোচনা করার জন্য এবার তাঁর জন্মদিনটাই বেছে নিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে লোকসমাগমে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি জন্মদিনের আয়োজন করতে মানা করে দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর থেকে এই হুঁশটা পেয়েছি।
হুঁশ না থাকলে সে কীসের মানুষ? আমরা আহমেদ সাব্বিরকে চিনি। তিনি তাঁর জায়গায় বসে নেই। ক’ জন আর আমরা খবর রাখি। তাঁর এই হুঁশ আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হোক। অনেকে বলেছেন, তাঁর জন্মদিনে কিছু বললে তিনি উৎসাহিত হবেন। কিন্তু এটা ভুল। তাঁর উৎসাহ তাঁর আত্মমূল থেকে উৎসারিত। তবুও আমাদের কিছু করণীয় আছে, শুভ মানুষকে পাশে রাখা। ্এই দুর্যোগে সেটাও কম শক্তি না। তাই সাব্বির ভাইকে শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন সাব্বির ভাই!
Email : bablujbl@gmail.com