অনলাইন ডেস্ক : অবশেষে করোনার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নেওয়া প্রতারণা চক্র জেকেজির সব ক্ষমতার উৎস ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়েছেন। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের এই রেজিস্ট্রার চিকিৎসককে পুলিশের তেজগাঁও ডিসি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর জেকেজির প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
রোববার (১২ জুলাই) দুপুরে তাকে তেজগাঁও ডিসির কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এসময় ডা. সাবরিনা দাবি করেন জেকেজির সঙ্গে অনেক আগেই সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেন বলে পুলিশের কাছে দাবি করেন। গত ৪ জুন জেকেজির সিইও এবং স্বামী আরিফুলের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ তুলে সাবরিনা তেজগাঁও বিভাগের একটি থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেছেন বলেও জানান তিনি। এর অন্তত দুই মাস আগে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে দাবি করেন সাবরিনা।
করোনা মহামারিতে ভাইরাস শনাক্ত নিয়ে এই স্পর্শকাতর প্রতারণায় শুরু থেকেই জড়িত প্রতিষ্ঠানটিতে সম্পৃক্ত ছিলেন ডা. সাবরিনা। তার আবেদনেই জেকেজি হেলথকেয়ার করোনার নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপনের কাজ পায়। তিনি নিজে জেকেজির কর্মীদের তিতুমীর কলেজে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অথচ তারই প্রতিষ্ঠান করোনা টেস্টের নামে দিনের পর দিন মানুষকে ঠকিয়ে আসছিল তার প্রতিষ্ঠান। সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও তিনি ছিলেন জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান। এই পরিচয়ে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং কথা বলতেন গণমাধ্যমের সঙ্গে। এটি সরকারি চাকরি বিধিমালার সুষ্পষ্ট লংঘন।
কিভাবে, কার মাধ্যমে তিনি এ কাজ হাতিয়েছেন, সে ব্যাপারে চলছে অনুসন্ধান। প্রতারণার দায়ে স্বামী আরিফ চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর জেকেজির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করে ১৫ হাজার ৪৬০ টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহের অভিযোগ ওঠেছে জেকেজির বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ অস্বাকার দাবি করেছেন, তিনি এক মাস আগেই পদ ছেড়ে দিয়েছেন। আবার বলছেন যে তিনি কখনওই চেয়ারম্যান ছিলেন না, সবাই নাকি মুখে মুখে ডাকতো।
অনলাইনে ও মিডিয়ায় তুমুল আলোচিত এই চিকিৎসক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে বাংলাদেশের প্রথম নারী কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে দাবি করে আসছেন। যদিও তার এ দাবি পুরোপুরি মিথ্যা বলে জানিয়েছেন হৃদরোগ ইনস্টিউটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান এবং তার অন্য সহকর্মীরাও। তারা জানান, বাংলাদেশের প্রথম নারী কার্ডিয়াক সার্জন হলেন ডা. শিমু পাল। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ম-২৯ ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন।২০০৯ সালে এমএস কোর্স শেষ করে বাংলাদেশের প্রথম নারী কার্ডিয়াক সার্জন হন তিনি এখন পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্র থাকেন।
ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার চিকিৎসক হয়েও নিয়মিত দায়িত্ব পালন না করা, নিজের ইচ্ছেমত চলা, অনৈতিক সুবিধা নেয়া, এমনকি অধীনস্থদের সাথে দুর্ব্যবহার করাসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে।
ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণায় জেকেজি প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরীসহ আরো বেশকজন কর্মকর্তা বা কর্মচারি গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই নিজেকে রক্ষায় প্রভাবশালী বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন সাবরিনা। চিকিৎসকদের একটি প্রভাবশালী সংগঠনের এক প্রভাবশালী নেতার বান্ধবী হওয়ায় নিজেকে রক্ষায় ওই নেতার মাধ্যমে চেষ্টা তদবির চালিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেন এই নারী চিকিৎসক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই দম্পতির জীবনও রূপকথার গল্পের মতো। আরিফের চতুর্থ স্ত্রী সাবরিনা। আরিফের এক স্ত্রী থাকেন রাশিয়ায়, অন্যজন লন্ডনে। আরেকজনের সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সাবরিনার হাত ধরেই করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি বাগিয়ে নেয় অনেকটা অখ্যাত জেকেজি নামে এই প্রতিষ্ঠান। প্রথমে তিতুমীর কলেজের মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা এবং অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিল তারা।
স্বামী-স্ত্রী মিলে করোনা টেস্ট নামে প্রতারণা করলেও করলেও তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের নয়। স্ত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পেয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এক চিকিৎসককে মারধর করেন আরিফ চৌধুরী। পরে এ ঘটনায় স্বামীর বিরুদ্ধে শেরেবাংলানগর থানায় জিডি করেন ডা. সাবরিনা। এ ছাড়া জেকেজির এক কর্মীকে অশালীন প্রস্তাব দেওয়ার ঘটনায় গুলশান থানায় আরিফ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। বিএমএর নেতার পরিচয় ভাঙিয়ে চলাফেরা করেন ডা. সাবরিনা।
চিকিৎসক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরুর আগে সিনেমার নায়িকা হতে চেয়েছিলেন সাবরিনা। খোলামেলা পোশাকে নানা ভঙ্গিমায় তোলা ছবি নিয়ে একসময় তিনি এফডিসিতে নির্মাতাদের পেছন পেছন ঘুরেছেন। কিন্তু কারো পাত্তা না দেওয়া তাকে হাল ছাড়তে হয়। পরে চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও কিন্তু নায়িকাদের মতো চালচলন তিনি বজায় রাখেন। সোশাল মিডিয়া ও ইউটিউবে ডা. সাবরিনা আরিফের অসংখ্য ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে আছে। এসব ক্লিপিংয়ে তিনি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন টিপস দিয়ে থাকেন । ভিডিওতে দেখা যায় স্বাস্থ্যের টিপস দেয়ার চেয়েও নিজের দেহবল্লরী উপস্থাপনে বেশি মনোযোগী।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সাবরিনা ও আরিফ দম্পতি দীর্ঘদিন ধরেই বেপরোয়া। নানান অনৈতিক কাজের সঙ্গে তারা জড়িত। বিভিন্ন অনৈতিক কাজকর্ম করে তারা কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। ঢাকার গুলশানের শাহজাদপুরের কনফিডেন্স টাওয়ারে জেকেজি তথা ওভাল গ্রুপের অফিসটিতে আরিফ-সাবরিনা দম্পতি গড়ে তোলেন মধ্যরাতের বালাখানা। প্রায় প্রতিসপ্তাহেই সেখানে জমতো ডিজেপার্টি। নারীপুরুষ মেলামেশার পাশাপাশি অবাধে চলতো মদ আর ইয়াবা। কনফিডেন্স টাওয়ারের একাধিক কর্মী জানান, গভীর রাতে বাসায় ফেরার জন্য গাড়িতে ওঠার সময় ম্যাডামকে তারা দেখেছেন মাতাল অবস্থায়। এমনকি মাঝে মধ্যে তিনি টাল হয়ে অচেতন অবস্থায় অফিসেই রাত্রিযাপন করেছেন। ওই টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, একাধিকবার টাওয়ারের কার পার্কিং এলাকায় স্যার (আরিফ) ও ম্যাডামকে (সাবরিনা) তারা ঝগড়া করতে দেখেছেন। এসময় এই দম্পতিকে পরস্পরের প্রতি অশ্লীল ও নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করতেও শুনেছেন অনেকেই।
একসঙ্গে একাধিক এক্সট্রা ম্যারিটিয়াল এফেয়ারে নিজেকে জড়ান ডা. সাবরিনা। এমনই একটি সম্পর্ক তিনি গড়ে তুলেন হৃদরোগ ইনস্টিউটিউটের একজন সিনিয়র কার্ডিয়াক সার্জনের সঙ্গে, যিনি একই সঙ্গে সরকার সমর্থক চিকিৎসক সংগঠনের প্রভাবশালী নেতা। তার মাধ্যমেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রভাব খাটিয়ে আদায় করে নিতেন নিয়মবহির্ভূত নানা আব্দার। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ওই কার্ডিয়াক সার্জনের সঙ্গে তারই রুমে সাবরিনাকে আপত্তিকর অবস্থায় আবিষ্কার করেন স্বামী আরিফ চৌধুরী। এটি মেনে নিতে না পারায় ওইখানেই আরিফ ওই কার্ডিয়াক সার্জনকে অপমান করেন এবং সাবরিনাকে চড়থাপ্পড়। স্বামীর সঙ্গে সাবরিনার দূরত্ব তৈরি হয় এখান থেকেই। এখন করোনা টেস্ট প্রতারণায় স্বামী গ্রেপ্তার হয়ে এই ঘটনাকে হাইলাইট করে নিজেকে বাঁচাতে বলছেন, আমি জেকেজি ছেড়ে দুইমাস আগেই চলে আসি। যদিও তাকে একমাস আগেও তিতুমীর কলেজের ক্যাম্পাসে নিজেকে জেকেজি চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে মিডিয়াতে কথা বলতে দেখা গেছে।
অনেক কৌশল আর তদবিরের পরও শেষরক্ষা হয়নি প্রতারণা চক্রের নেপথ্য সমাজ্ঞী ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর। করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, করোনা টেস্ট নিয়ে জেকেজি হাসপাতালের জালিয়াতির ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা অধিকতর তদন্তের স্বার্থে ডা. সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।তাকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ড চেয়ে সোমবার (১৩ জুলাই) আদালতে তোলা হবে।
এদিকে ডা. সাবরিনা গ্রেপ্তার হওয়ার পরই তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রোববার (১২ জুলাই) মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুল মান্নান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বলা হয়, সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সরকারের অনুমতি ছাড়াই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থাকা এবং অর্থ আত্মসাৎ সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনকে সরকারি কর্মচারী বিধিমালার বিধি ১২ (১) অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।