নিজস্ব প্রতিনিধি : জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশে গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণের লক্ষ্যে দুটি প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। প্রকল্প দুটির মধ্যে একটি হলো জমি আছে গৃহ নেই। আর যাদের জমি বা গৃহ কিছু নেই। প্রকল্প দুটির মধ্যে জমি আছে গৃহ নেই এমন ব্যক্তিদের গৃহ নির্মাণের জন্য ১লক্ষ ২০ হাজার টাকা এবং যাদের জমি ও বা গৃহ নেই তাদের জন্য ১লক্ষ ৭১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গৃহ নির্মাণ কাজে কলারোয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গরীব ও অসহায়দের জন্য মানসম্মত গৃহ নির্মান নিশ্চিত করার জন্য উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা এটি নির্মাণ করে আসছেন। নির্মাণ কাজে যথাযথ তদারকি না থাকাসহ কাজে অভিজ্ঞতা শুণ্যের কোঠায় থাকায় কাজের মান নিয়ে ঝড় বইছে গৃহে ওঠা গরীব অসহায়দের মনেও।
জানা গেছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে গৃহহীনদের মাঝে গৃহ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়ছেন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা। সরকারি বরাদ্দকৃত প্রথম পর্যায়ে কলারোয়া উপজলা ৬০টি ঘরের প্রতিটি ঘরের নির্মান বরাদ্দ ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। গৃহনির্মাণ কাজ শুরু থেকে যেন তেন ভাবে শুরু করা হয়।
কেরালকাতা ইউনিয়নের দরবাসা গ্রামের গৃহহীন পরিবারর সদস্য মেহের আলীর স্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী তার নামে একটি ঘর বরাদ্ধ দেয়। ঘরের নির্মাণ কাজ যারা করেছে (রাজমিস্ত্রি) তারা ১০ বস্তা সিমেন্টের সাথে ৪ টলি বালি মিশিয়ে কাজ করায় কাজ খুব ভালো মানের হয়েছে বলে তার মনে হয়নি। একই ইউনিয়নের ফাজিলকাটি গ্রামের জবেদা খাতুনের স্বামী মোহর আলী জানান, ঘরের কাজ খুব নিন্ম মানের হয়েছে। তিনি অভিযোগ জানিয়ে বলেন এই ঘরের টয়লেটের স্লাব ব্যক্তিগতভাবে ক্রয়ের জন্য ঠিকাদার তাকে নির্দেশ দেয়। নিন্ম মানের ৪টি ব্রান্ডের সিমেন্ট ব্যবহারে ঘরের নির্মাণ কাজ দুর্বল হয়ে গেছে। জোরে ঘষা দিলেই ঘরের পলিস্তরা খসে পড়ছে। তিনি আরও জানান ৩ ট্রলি বালির সাথে মাত্র ১৫ বস্তা সিমেন্টের কাজ করায় কাজ ভালো হয়নি।
পুটুনী গ্রামের রবিউল ইসলামের স্ত্রী মনজুয়ারা খাতুন প্রধান মন্ত্রীর বরাদ্দকৃত ঘর উপহার হিসাবে পাওয়ায় শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঠিকাদার কর্তৃক নির্মাণধীন ঘরের ভিত (পোতা)’র গভীরতা না করে একটা ইটের উপর দেয়াল নির্মান করা হয়েছে। চালের (ছাউনী)’র জন্য মেহগনি কাঠ ব্যবহার করার নির্দেশ থাকলেও সেটি উপেক্ষা করে নারিকেল গাছের চিকন দুর্বল কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। ঝড়ে যা উড়ে যাওয়ার সম্ভবনা শতভাগ। প্রতিটি গৃহের অবকাঠামাগত দূর্বল হয়েছে। তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন দূর্বল ঘরটি আনুমানিক ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ব্যয় নির্মান করায় যে কোন সময় ঘরটি ভেঙ্গে হতাহতের মতো দূর্ঘটনা ঘটতে পারে ।
এবিষয়ে ঠিকাদার সুভাষ কুমার বলেন, ইট নি¤œমানের, বালু কম, সিমেন্ট কম এধরনের অভিযোগ গুলো মিথ্যা। এছাড়া স্লীবের জন্য কারো কাছে টাকাও দাবি করা হয়নি। ইউএনও স্যার আমাকে বলেছেন এ কাজে কোন ধরনের অনিয়ম মেনে নেওয়া হবে না। পুরো বরাদ্দের টাকাতেই কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
সরকারি বরাদ্দকৃত গৃহহীন মানুষের নির্মাণধীন ঘরের জন্য নায্য মূল্য ইট ক্রয়ের সরকারি টাকা বরাদ্দ থাকলেও কলারায়া উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মৌসুমী জেরীন কান্তা উপজেলায় অবস্থিত ১৯ টি ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে চাপ প্রয়োগ করে ৭ হাজার ইট গ্রহণ করেছেন। যারা ইট দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তাদেরকে বাধ্যতা মূলক নগদ ৫০ হাজার টাকার ইউএনওকে দিতে হয়েছে। কিছু কিছু ইট ভাটার মালিকের কাছ থেকে সু-কৌশলে নায্য মূল্য না দিয়ে বাধ্যতামূলক ভাটা থেকে ইট বহন মূল্যসহ হাজার প্রতি ৬ হাজার ২শত টাকা করে ৫০ হাজার ইট ক্রয় করেছেন বলে উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটার মালিক এবং কর্মরতরা জানিয়েছেন।কলারোয়ার গাজী ভাটার ম্যানেজার উত্তম চন্দ্র জানান, কলারোয়ার ইউএনও সাহেব কম টাকায় ইট ক্রয় করেছে। লোকসান এড়াতে ভাটা গৃহনির্মানের হেড মিস্ত্রির সাথে যোগাযোগ করে কৌশলে এক হাজার ইট ১ নং দিয়েছেন তো ৫ হাজার দিয়েছেন ৩ নং ইট। এসব ঘর বেশী দিন টিকবে না বলে তার ধারনা। এমন সব নানা কারনে গৃহ নির্মান অসম্ভব আকারে দুর্বল হয়েছে বলেও এলাকাবাসি মন্তব্য করেন।
ইট ভাটার মালিক আয়ুব আলী মেম্বর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন ইটের বাজার মূল্য বহনসহ হাজার প্রতি ৮ হাজার টাকা।অন্য ভাটা মালিক ফারুক হোসেন জানান, আমার ভাটায় পর্যাপ্ত ইট তৈরি সম্ভব হচ্ছে না বলে বাধ্য হয়ে ইউএনওকে আমি নগদ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি যেটা অফেরৎযোগ্য। কলারোয়া কুশোডাঙ্গা ইউনিয়নের ভাটা মালিক আলমগীর হোসেন জানান, বিনা মূল্যে প্রথম কোটায় ৬ হাজার ইট দিয়েছি। পরে ১ হাজার ইট দরবাসা গ্রামের মেহের আলীর বাড়িতে দিয়েছি। এরপর ফের ৩ হাজার ইট ফাজিলকাটি জবেদার বাড়িতে দিয়েছি। অন্যস্থানেও ১হাজার ইট দ্রুত পাঠাতে হয়েছে। বিনা টাকায় আর কত পারা যায়? না দিলে অভিযান চলবে।
কেরালকাতা ইউনিয়ন পরিষদের পাশে অবস্থিত রয়েট ভাটার মালিক কবির হোসেনের নিকট ইউওনো স্যারকে কত হাজার ইট দিচ্ছেন জানতে চাইলে ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, করোনা ভাইরাসের কারনে আমরা ঠিকমত ব্যবসা করতে পারছিনা তার মধ্য ইট না দিলে ভাটা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইউএনও। যা অত্যন্ত কষ্টদায়ক আমি ৭ হাজার ইট বাধ্য হয়েই বিনামূল্যে দিয়েছি। এছাড়া একাধিক ভাটা মালিকের নিকট হতে একই ভাবে ইট দেয়ার কথা রয়েছে। এসব ইট দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের ঘর নির্মান করা হচ্ছে। চাঁদার ইটে গরীব নাম কামানো।
খোঁজ নিয়ে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিনা টাকাসহ কম মূল্য ইট না দিল উপজেলায় ভাটা চালাতে দেওয়া হবে না মর্মে ইউএনও হুমকি দিয়েছেন। ইতোমধ্য কয়েকটি ভাটার মালিক ইউএনও’র নির্দেশনা অনুযায়ী দাবিকৃত ইট গৃহনীর্মাণের জন্য নিজ খরচে বিভিন্ন স্থানে পৌছে দিয়েছেন।
উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে নির্মান সমাপ্ত হওয়া বাস গৃহ ও নির্মানাধীন বাস গৃহ পরিদর্শনকালে এলাকাবাসিদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, গরীব অসহায় ও গৃহহীনদের এসব বাসগৃহ নির্মানে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। ভিত না খুড়ে আলগা মাটির উপর থেকে ইটের গাঁথুনি শুরু করা হয়েছে। পরে ভিতের মধ্যে মাটি ভরাট করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুম আসলেই ভিতের নিচের মাটি সরে যেয়ে প্রতিটি ঘরের মেঝে ও দেয়াল ফেটে যাবে। এসময় যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড় হয় তাহলে ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা আছে। ইটের গাঁথুনির সময় পর্যাপ্ত পরিমানে দেয়ালে পানির ব্যবহার করার নিয়ম থাকলেও দেয়াল গাঁথুনির পর তা পানি দিয়ে ভেজানো হয়নি। ফলে ইটের জয়েন্ট ছেড়ে দিয়ে সিমেন্ট ঝরে যাবে। দেয়ালের পলিস্তারা পানি দিয়ে ভোজানো হয়নি। নির্মানের পর তড়ি ঘড়ি করে কোন রকমে এসব ঘরের দেয়ালে সাদা রং করে গৃহহীনদের প্রদান করা হয়েছে। সিমেন্টের সাথে বালির মিশ্রনও নিয়ম মেনে করা হয়নি। যে সব স্থানে এসব গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে তার আশপাশে বসবাসরত লোকজন নিশ্চিত করে বলেন, গৃহ নির্মানের আগে নিয়ম সেখানে পানির জন্য টিউবওয়েল স্থাপন করা। সে সব না থাকায় মিস্ত্রিরা দুর থেকে বালতি, কলস ও বদনায় করে পানি এনে এসব গৃহ নির্মাণ শেষ করেছে। রাতের আধারে মিস্ত্রিরা ঘরের মেঝের কাজ করেছে। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিম করে সরেজমিনে এসবের তদন্ত করলে গৃহ নির্মানের ত্রুটি সহজেই বেরিয়ে আসবে। এলাকাবাসির দাবি সরকারি অর্থ নয় ছয় করা হয়েছে। বরাদ্ধের সব অর্থ নিয়ম মেনে খরচ করলে এসব গৃহ বহুদিন টেকসই হতো। আগামী ৩ বছরের বেশী এসব ঘর টিকবে না বলে প্রতাক্ষদর্শীরা মনে করেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের অসহায় মানুষের গৃহ নির্মাণের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছেন। এই টাকার মধ্যেই গৃহ নির্মাণ অনায়াসে শেষ করা যায়।
গৃহ নির্মানের ত্রুটির বিষয় নিয়ে কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী জেরীন কান্তার সাথে যোগাযোগ করলে কলারোয়ায় গৃহ নির্মানে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন সঠিক ভাবেই কাজ করা হয়েছে। আপনারা সরেজমিনে পরিদর্শন করে আসুন। উদ্দেশ্য মূলকভাবেই এ ধরনের অভিযোগ করা হয়েছে।
কলারোয়ায় মুজিববর্ষের গৃহ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম
পূর্ববর্তী পোস্ট