বাঙ্গালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সময় ১৯৭১, শ্রেষ্ঠ ঘটনা স্বাধীনতার যুদ্ধ এবং শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। স্বাধীনতা এসেছিল দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদদের। গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বরণ করি সব নারী ও পুরুষকে, যাঁরা নিজ নিজ অবস্থান ও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সম্ভব করে তুলেছিলেন স্বাধীন সার্বভে․ম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ সব নেতার স্মৃতির প্রতি আমাদের বিন¤্র শ্রদ্ধা। দীর্ঘ নয় মাসের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি ৩০ লাখ শহীদকে, দুই লাখ মা-বোনের ওপর চলেছিল সীমাহীন বর্বরতা। সেই সব শহীদ- পরিবারের সদস্যরা আজও বয়ে চলেছেন স্বজন হারানোর দূঃসহ বেদনা। তবে বেদনার বিপরীতে গে․রব আর আনন্দও আছে। ২৬ মার্চ থেকে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল নয় মাস পর ১৬ ডিসেম্বর সেই যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তিতে আমরা অর্জন করেছিলাম গৌরবের বিজয়।
বাঙ্গালি জাতি আজও ভুলতে পারে না গোটা জাতি যে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধে। সেই হানাদারদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এ দেশের কতিপয় মানুষ। তারা শুধু পাকিস্তানি বাহিনীকে গণহত্যায় সহযোগিতা করে ক্ষ্যান্ত ছিল না, নিজেরাও অস্ত্র ধরেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী সেদিন এই দেশের নিরীহ শান্তি প্রিয় মানুয়ের ওপর চালিয়েছিল মানবতার বিরুদ্ধে নানা অপরাধ। বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ চলমান রাখলেও সংশয়, সন্দেহ দূর হয়নি। দ্রুত বিচারকাজ শেষ হোক, সেটাই সবার প্রত্যাশা।
২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছি। ২৬ মার্চ ২০২১ সাল স্বাধীনতার ৫০ বছর ইতিহাসের বিচারে এটি দীর্ঘ না হলেও কোনো জাতির অগ্রগতির জন্য একেবারে কম সময়ও নয়। মুক্তিযুদ্ধে এত আত্মদান ও ত্যাগ তিতিক্ষার পেছনে আমাদের যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন ছিল, সে সবের কতটা পূরন হয়েছে। আমাদের পুরো মুক্তি সংগ্রামের মর্মকথা ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সব ধরনের অন্যায় অবিচার, বৈষম্য থেকে মানুষের মুক্তি। আতœজিজ্ঞাসা? সেই পথে আমার কী বেশিদূর এগোতে পেরেছি? অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি নিশ্চয়ই হয়েছে স্বল্পোন্নত দেশেরে তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তণের জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছি। উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার, গড়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা অর্থাৎ গড়ে মাসে প্রায় ১৪ হাজার ৬০০ টাকার মতো। মানব সম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৬ পয়েন্টের প্রয়োজন, বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭৫.৩। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি নিশ্চিত।
স্বাধীনতার পর “তলাবিহীন ঝুড়ির” দেশ আখ্যা দিয়ে যারা অপমান-অপদস্থ করেছিল, সেই তাদের কন্ঠেই বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা। দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের রোল মডেল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি সহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের এই ক্ষনে সমৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত রাখতে সম্মিলিতভাবে আমাদের কাজ করতে হবে। প্রযুক্তির নির্ভর জাতীয় ভিত গড়তে আমরা পেয়েছি রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট যা পৃথিবীর ৫৭ টি দেশের সমান জাতীয় গৌরবের অংশ। ‘গ্লোবাল স্কীলস ইনডেক্স- ২০১৯’ (জি.এস.আই) অনুযায়ী, প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিক থেকে অপারেটিং সিস্টেম, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো ক্ষেত্রে ভালো করছে বাংলাদেশ, ই-গভর্নমেন্ট মাস্টার প্ল্যান রিপোট অনুযায়ী চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খতে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। বর্তমানে এ খাতের আয় ১০০ কোটি ডলার। ২০২১ সালে এই খাতের আয় ৫০০ কোটি ডলারে উত্তীর্ণ করার লক্ষ্য নির্ধারন করা হয়েছে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ তম বার্ষিকীতে ঢাকায় ডব্লিউ.সি.আই.টি সম্মেলনে বিশ্বের ৮৩ টি দেশের প্রতিনিধিগণ অংশ নেবেন। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ডিজিটাল বাংলাদেশের উন্নতির প্রশংসা ইতিমধ্যে সারা বিশ্ব থেকে আসছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে শেষ স্প্যান বসানোর মধ্যদিয়ে জাতির স্বপ্ন পূরণ ও স্বপ্ন ছুয়েছে প্রমত্ত পদ্মার এপার-ওপার। তিন বছর দুই মাস দশ দিনের মাথায় এলো সেই স্বপ্নের দিন। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সেতুতে শেষ স্প্যান বসানোর পর প্রমত্ত পদ্মার দুই পাড়ে রচিত হলো সেতুবন্ধন। বিশ্বনেতৃবৃন্দ ও বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে স্থান নিল এই সেতু। এক মহাকর্মযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে অবশেষে মাথা তুলে দাঁড়াল স্বপ্নের সেতু। মুক্ত হলো পদ্মার এপার-ওপার। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি, কিন্তু এবারের স্বাধীনতা দিবস আমাদের কাছে একটু অন্যরকম।
বর্তমানে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। স্কুল-কলেজ দীর্ঘদিন খুলছে না। শিক্ষার্থী ও শিক্ষানবিশদের মাঝে বাড়ছে হতাশা। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অর্থ‣নতিক অবস্থা শোচনীয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছে অপরাধ। সরকারের উদ্যোগে এ ধরনের সামাজিক বিষয়কে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানব জাতি এত ভয়াবহ সংকটে আর পড়েনি। প্লেগ, কলেরা, ইনফ্লয়েঞ্জার মতো মহামারিতে ব্যাপক মানুষের মৃত্যু হলেও পৃথিবীজুড়ে এমন শঙ্কা, অনিশ্চয়তা আর কখনও দেখা যায়নি। পৃথিবী আগে কখনও এভাবে স্থবির হয়নি, অবরুদ্ধ হয়নি। এরই মধ্যে টিকা এসেছে এবং তার প্রয়োগ হচ্ছে। অনেক দেশ বলছে, এগুলো কার্যকরও। তবে এ অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণের ক্ষত শুকাতে সময় লাগবে অনেক দিন।আরেকটা বিষয়, বাংলাদেশের মানুষ জন্মগতভাবেই বেশ সহনশীল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই নিজেদের টিকে থাকার পথ বের করে এগিয়ে চলে তারা। বাংলাদেশ নামক দেশটিও জন্মের পর থেকেই নানা সংকট কাটিয়ে আলোর পথে যাত্রা করে এগিয়ে চলেছে। এবারও পিছু হাটবে না। এদিকে করোনাকালে পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বছর জুড়ে মুজিবর্ষের অনুষ্ঠানমালাসহ প্রায় প্রোগ্রামই বাতিল কিংবা সীমিত করা হয়েছে। এছাড়া ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর সুফল কাজে লাগিয়ে অনলাইনেও কিছু কিছু অনুষ্ঠানমালার আযোজন করা হচ্ছে। একাত্তরে সংকট উত্তরণে নতুন স্বপ্নের নেতৃত্বে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পর উনয়নশীল বাংলাদেশের সামনে রয়েছেন তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই এবারও তারুণ্যনির্ভর এই জাতি সব বাধা উপেক্ষা করে ফের বাংলার আকাশে বিজয় কেতন ওড়াবে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে স্বাধীনতা দিবসের আলোকউজ্জ্বল নগরীর রাস্তায় দাঁড়িয়ে একজন দরিদ্র সাধারন নাগরিক যদি জিজ্ঞাসা করে এ স্বাধীনতা কার ? তার উত্তর কে দিবে ? স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরে এদেশের দৃশ্যমান উন্নয়ন অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নের অন্তরালে জনগনের সমস্যা , দারিদ্র্য, অভাব ও সংকট রয়েগিয়েছে। সন্ত্রাস, দুর্নীতির মূল শিকড় উৎপাটনে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিকে সাধুবাদ তবে এর ধারাবাহিকতা অব্যাহিত থাকবে সেই প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের মানুষকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, অনাচার ও শোষন থেকে মুক্ত করার যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন, সেই প্রত্যাশা আমাদের। যেন স্বাধীনতা কার ? প্রশ্নের উত্তর হয় আমার, আমাদের, বাঙ্গালী জাতির। সহ¯্র বছরের রক্তঘাম ও শ্রমের ফসল হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রামে দল-মত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসবেন, এই অঙ্গিকারে হোক স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী হোক আগামীর পথ চলা…..
তোফায়েল আমীন(অনিক সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্ণ)