ভিন্নরকম খবর : রাজধানীর কাফরুলের বাসায় ছিলেন জনৈক রুমানা জান্নাত (৪০)। ১৫ জুন দুপুর ১টা ২৬ মিনিটে ০১৮৮৪-২১২৬৫২ নম্বর থেকে তার কাছে একটি ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে নারী কণ্ঠে বলা হয়, ‘আমি আপনার শ্বশুরবাড়ির দিক দিয়ে আত্মীয়। আমার একজন রিলেটিভ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আজ তাকে রিলিজ দিয়েছে। হাসপাতালের বিল পাঁচ হাজার টাকা কম পড়েছে। টাকা পরিশোধ করা ছাড়া হাসপাতাল ছাড়তে পারছি না। আপনি আমাকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দিলে সন্ধ্যার মধ্যেই আপনাকে টাকা ফেরত দেব।’
সঙ্গে সঙ্গেই রুমানা একটি বিকাশ নম্বরে (০১৭৮১-৫০১৮১৯) পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। এ টাকা পাওয়ার পর রুমানাকে বলা হয়, ‘আমি আপনাকে ভুল করে পাঁচ হাজার টাকার কথা বলেছি। আসলে হাসপাতালে আমার ১০ হাজার টাকা লাগবে। আপনি আমাকে আর পাঁচ হাজার টাকা পাঠালে বেশ উপকার হয়।’ পরে রুমানা আরও পাঁচ হাজার টাকা পাঠান। এর ১ ঘণ্টা পর সেই নারী কণ্ঠধারী (প্রতারক) লজ্জিত ভঙ্গিতে আরও পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে বললে রুমানা তা পাঠান। এরপর নারী কণ্ঠধারী ব্যক্তিটি তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন। পরে সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে আবারও রুমানাকে ফোন করে পাঁচ হাজার টাকা পাঠানোর জন্য চাপ দেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই রুমানা আবার পাঁচ হাজার টাকা পাঠান। এরপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় ওই মোবাইল নম্বরটি।
নারী কণ্ঠধারী প্রতারকের নাম আলী আকবর হীরা (৫১)। ছেলে শেরে আলী জিতুকে (২০) নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রতারণার চক্র। মোবাইল ফোনের অপশনে নারী কণ্ঠ জুড়ে দিয়ে তারা ফোন করেন টার্গেট করা ব্যক্তিকে। ছেলে জিতু তার বাবাকে ভিআইপি সিরিয়ালের (০১৭১১১…, ০১৬১১১…, ০১৯১১ ইত্যাদি) মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে দেয়। আর ওইসব নম্বরে ফোনের ম্যাজিক ভয়েসকে কাজে লাগিয়ে নারী কণ্ঠে কথা বলেন বাবা হীরা। ৭ বছর ধরে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে আত্মীয় পরিচয়ে ই-ট্রানজেকশনের (বিকাশ, নগদ ও রকেট) মাধ্যমে তারা টাকা দাবি করেন। টাকা পাওয়ার পর আবারও নতুন বাহানায় টাকা দাবি করেন। যতক্ষণ পর্যন্ত ভিকটিমরা বুঝতে না পারেন যে, তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে বাবা-ছেলের প্রতারণা।
বুধবার রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সদস্যরা এ দুই প্রতারককে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারের পর তারা তাদের প্রতারণার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন ডিবির কাছে। পরে বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ চক্রের হাতে ১৭ জন প্রতারিত ব্যক্তি ইতোমধ্যে ডিবির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
ডিবি সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃতদের নামে রাজধানীর শাহবাগ এবং বরিশাল সদর থানাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় বেশ কয়েকটি মামলা আছে। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য তারা ই-ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিগত নম্বরে লেনদেন করত না। বাসার আশপাশের ই-ট্রানজেকশনের এজেন্ট নম্বরের মাধ্যমে টাকা তুলে আত্মসাৎ করত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টাকা তুলত জিতু। কখনো কখনো প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকা তারা এজেন্টদের কাছ থেকে নিজেদের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে নিত। তাদের এলাকায় বিভিন্ন ই-ট্রানজেকশন এজেন্টের দোকানের ক্যাশ আউট স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। হীরা এবং জিতুর বৈধ কোনো আয়ের উৎস নেই। তাদের মূল পেশাই ছিল প্রতারণা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, বাবা-ছেলের প্রতারণার প্রধান টার্গেট হল ভিআইপি সিম ব্যবহারকারীরা। তাই তারা ভিআইপি সিম সিরিজের নম্বরগুলোতে এক ডিজিট পরিবর্তন করে ফোন করত। ফোন করার আগে সেই নম্বর ইমো অ্যাপসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর নাম জেনে নিত। কেউ কল রিসিভ করার পর তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় পরিচয় দিত। মহিলা কণ্ঠে কথা বলে ধীরে ধীরে ভুক্তভোগীর বিশ্বাস অর্জন করে নিত। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ৩টি মোবাইল সেট ও ৪টি সিম জব্দ করা হয়েছে বলে জানান এডিসি।