অাহম্মাদ উল্যাহ বাচ্ছু কালিগঞ্জ থেকেঃ
সরকারের বেশকিছু মেগা প্রকল্প ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে যে কোন সময়ের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলেছে দেশ। গত ১০ বছরে লক্ষ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এখনো অনেক কাজ চলমান রয়েছে। তবে জনগণের টাকায় বাস্তবায়িত এসব অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। তেমনি কালিগঞ্জ উপজেলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরসহ বেশ কিছু সময়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে হেরফেরের অভিযোগ উঠেছে মথুরেশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গাইনের বিরুদ্ধে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি), বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়িত লোকাল গভর্নেন্স সাপোর্ট প্রজেক্টের (এলজিএসপি), গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণা বেক্ষণ (টিআর) এবং কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্প। গত ১ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম। লিখিত অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম বলেন, সরকার উন্নয়নের জন্য প্রকল্প বরাদ্ধ দিয়েছে।কাগজ-কলমে সবই ঠিক আছে। সময়মত প্রকল্পের টাকাও উত্তোলন করা হয়েছে । কিন্তু অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ বাস্তবে হয়নি। গ্রামীণ অবকাঠামোর সংস্কারের নামে মসজিদ, মন্দির, রাস্তঘাট উন্নয়ন প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট জায়গায় উন্নয়নের কোন ছোয়া লাগেনি। এমনকি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জানেনও না উন্নয়ন কাজের খবর। অথচ এসব প্রকল্পের নামের টাকা উত্তোলন করে পকেটস্থ করেছেন খোদ ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা। সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, প্রকল্পের খোঁজ মিলেছে, কিন্তু বাস্তবে আদৌ কোন কাজ করা হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধার এমন অভিযোগের পর থেকে এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তর থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের নথিপত্র খতিয়ে দেখে সরেজমিনে গেলে এসব অভিযোগের সত্যতাও মেলে।
মথুরেশপুর ইউনিয়নের বসন্তপুর, গনপতি, হাড়দ্দাহ, রায়পুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাগজে কলমে প্রকল্প থাকলেও সরেজমিনে বেশ কিছু প্রকল্পে কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু প্রকল্পের টাকা উত্তোলন ঠিকই করা হয়ে গেছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এলজিএসপির বরাদ্দে বসন্তপুর গ্রামের পানি নিষ্কাশনের আউট ড্রেন নির্মাণ। হাড়দ্দাহ কলগেট হইতে ঘূর্ণিঝড়ের আয়লার পানি প্লাবন হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাটি রাস্তা নির্মাণ। দুই প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৪ লাখ টাকা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ড্রেন নির্মাণ কাজ মোটেও করা হয়নি, আর মাটির রাস্তা দরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচি (৪০ দিনের) শ্রমিক দিয়ে কাজ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। এছাড়াও ২০১৯-২০ অর্থবছরে এলজিএসপির আওতায় বসন্তপুর গ্রামের পোট প্রাইমারী স্কুলের সামনে হইতে মুনছুর গাজীর বাড়ি পর্যন্ত ইটের রাস্তা নির্মান (পার্ক রাস্তা) প্রকল্পে ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোন কাজ হয়নি। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এলজিএসপির ১ লাখ টাকা বরাদ্দে দেয়া মনোরঞ্জন ঘোষের বাড়ি হইতে নিলকোমল ঘোষের বাড়ির অভিমুখে ইট সোলিং নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরুর কথা ছিল। এ ব্যাপারে মনোরঞ্জন ঘোষ জানান, তার বাড়ির সামনে কোনো কাজই দেখেননি তিনি। এছাড়াও ৭৯ হাজার ৮’শ টাকা বরাদ্দের উজয়মারী জয়দেবের বাড়ির মুখ হইতে উজয়মারী প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার হয়নি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রায়পুর আওয়ামী লীগ নেতা নরিম মাস্টারের বাড়ির সামনে ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে ১ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোন কাজ করা হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা।এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এলজিএসপির আওতায় বসন্তপুর বাবু মেম্বরের বাড়ির সামনে পানি জলাবদ্ধতা নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন নির্মাণ এবং বসন্তপুর কালার বাড়ির সামনে পানি জলাবদ্ধতা নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন নির্মাণ প্রকল্প দুটির বরাদ্দ ছিল ৪ লাখ টাকা। কিন্তু এসব প্রকল্প দায়সারা ভাবে কাজ হওয়ায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের (টিআর) আওতায় বসন্তপুর বাইতুল মামুর জামে মসজিদ সংস্কার ও মুকুন্দপুর পুরাতন শিবমন্দির সংস্কার প্রকল্পে বরাদ্ধ ছিল ৯৩ হাজার ৪’শ টাকা। সংস্কারের নামে মসজিদ, মন্দির প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নের কোন ছোয়া লাগেনি। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও জানেন না উন্নয়ন কাজের খবর। অথচ এসব প্রকল্পের নামে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) আওতায় গনপতি কালী বাড়ি মন্দির উন্নয়নে ৪৫ হাজার টাকা বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় এ গ্রামে কোন কালী মন্দিরের কোন অস্তিত্ব নেই। ২০১৮ সালের ৬ মে উপজেলা পরিষদের সভাকক্ষে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রয়াত শেখ ওয়াহেদুজ্জামানের সভাপতিত্বে সভায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এডিপির অধীনে মথুরেশপুর ইউনিয়নের বসন্তপুর আজিজুলের বাড়ীর সামনে হতে সামছুলের বাড়ীর কালভার্ট অভিমুখে ড্রেন নির্মানে দেড় লাখ টাকা দরপত্র দেখিয়ে প্রকল্প গ্রহন করা হয়।
সরেজমিনে যেয়ে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। এমনিভাবে এলজিএসপি ও এডিপির অধীনে আরো কয়েকটি প্রকল্প একাধিকবার বিভিন্ন বরাদ্দের তালিকায় দেখানো হয়েছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে- বসন্তপুর সাইদুলের বাড়ির মুখ হইতে করিম মাস্টারের বাড়ি অভিমুখে নতুন ইট সোলিং রাস্তা নির্মাণ (বরাদ্দ), বসন্তপুর গ্রামে মোঃ শওকাত গাজীর বাড়ি হতে মোঃ আব্দুস সবুরের বাড়ি পর্যন্ত পাকারাস্তা নির্মাণ (দরপত্র), মথুরেশপুর ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামের হাওলাদার বাড়ির মোড় হতে আল আমিন মাস্টারের বাড়ি অভিমুখে পাকারাস্তা নির্মাণ (দরপত্র), বসন্তপুর সবুরের বাড়ী হতে ওয়াবদা পর্যন্ত রাস্তায় ইট সোলিং (দরপত্র)। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একই প্রকল্পের নাম বারবার বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়ে ও প্রকল্প সভাপতির নাম পাল্টিয়ে এসব অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম অভিযোগ করে বলেন, আমার ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান ও পিআইওর দায়বদ্ধতার মধ্যেও পড়ে। তাই দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই। মথুরেশপুর ইউপি সদস্য শেখ আলাউদ্দীন সোহেল বলেন, প্রকল্পে গনপতি কালী বাড়ি মন্দির উন্নয়ন লেখা হয়েছে। আদৌ গনপতি গ্রামে কোন কালী বাড়ি মন্দির নেই। তবে অন্যান্য ইউপি সদস্যরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রকল্পের বিভিন্ন কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিরাজ হোসেন খান বলেন, গনপতি কালী বাড়ি মন্দিরের বিষয়টি আমার নলেজে আছে। প্রকল্পের কাজ দেখেই বিল দেওয়া হয়। তারপরও বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গাইনের ব্যবহ্নিত ০১৭৩০৯৮৬৯২৩ মুঠো ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে ফোনটি বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) জাকির হোসেন বলেন, আমি আসার আগেই অনেক কাজ শেষ হয়েছে। তারপরও এডিপি’র কাজে জালিয়াতি করার কোন সুযোগ নেই। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যদি কাজ না করে টাকা উত্তোলন করে থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে যথাযত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী বলেন, এলজিএসপি’র কাজ না করে বিল নিয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান অন্যায় করেছেন। এখানে লুটপাট ও অদৃশ্য প্রকল্প তৈরির কোনো সুযোগ নেই। মথুরেশপুর ইউনিয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার রবিউল ইসলাম এর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।