অর্থনীতির খবর: মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) জনজীবন ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যেন অনেকটা আশীর্বাদ নিয়ে এসেছে। মহামারির মধ্যেও এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সম্পদের পরিমাণ। সেই সঙ্গে ভালো অবস্থায় রয়েছে পরিচালন নগদ প্রবাহও।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত টেলিযোগাযোগ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক চিত্র পর্যালোচনা করে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।
বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে টেলিযোগাযোগ খাতের বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড, গ্রামীণফোন এবং রবি—এই তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। করোনার মধ্যে তিন প্রতিষ্ঠানেরই মুনাফায় বড় উন্নতি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে রবি। প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেড়ে প্রায় ১০ গুণ হয়েছে।
মহামারিকালেও প্রতিষ্ঠানগুলো রমরমা ব্যবসা করার কারণ হিসেবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার মধ্যে ঘরবন্দি জীবনে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার পেছনে এটিই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
তারা আরও বলেছেন, করোনার কারণে ইন্টারনেটের ব্যবহার যে পরিমাণ বেড়েছে তা সামনে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ মানুষ এখন অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে। ঝামেলা এড়াতে এখন অনেক কাজই মানুষ অনলাইনে করতে অভ্যস্ত হচ্ছে। তাছাড়া সামনে ফাইভ-জি এলে ইন্টারনেটের ব্যবহার আরও বাড়বে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইন্টারনেটের একচেটিয়া ব্যবসা বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল)। সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন এই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান দেশের মূল টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী সংস্থা। এটি বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটর।
আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে আত্মপ্রকাশ করে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০১২ সালে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে মুনাফার ধারায়। তবে করোনার মধ্যে কোম্পানিটির মুনাফায় বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে।
সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩ টাকা ২১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২ টাকা ১ পয়সা। এ হিসেবে মুনাফা বেড়েছে ৬০ শতাংশ। মুনাফায় এমন উন্নতি হওয়ার পাশাপাশি সম্পদমূল্যও বেড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকা ৭১ পয়সা, যা তিন মাস আগে, জুন শেষে ছিল ৫২ টাকা ৪৯ পয়সা।
চলতি বছরের তিন মাস ছাড়াও করোনার মধ্যে ২০২০ সাল জুড়েই ভালো ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে ২০২০-২১ হিসাব বছরে কোম্পানিটির কর পরবর্তী নিট মুনাফা হয় ১৯০ কোটি ৭৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা, যা ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ছিল ৯০ কোটি ৫৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এ হিসাবে কোম্পানিটির মুনাফা ১১১ শতাংশ বেড়েছে।
দেশের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন। ১৯৯৬ সালের ২৮ নভেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে মোবাইল অপারেটর হিসেবে অনুমতিপত্র পাওয়া গ্রামীণফোন ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ তার কার্যক্রম শুরু করে।
টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানোর পরও মহামারিকালে কোম্পানিটির মুনাফার ধারা থেমে থাকেনি। করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি কর-পরবর্তী মুনাফা অর্জন করে তিন হাজার ৭১৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। করোনার আগের বছর কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল তিন হাজার ৪৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ হিসাবে মুনাফা বেড়েছে ৮ শতাংশ।
এদিকে সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে বা জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১৯ টাকা ২৩ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৯ টাকা ৮৯ পয়সা। এ হিসেবে আগের বছরের তুলনায় কোম্পানিটির মুনাফা কিছুটা কমেছে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত টেলিযোগাযোগ খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান রবি আজিয়াটা লিমিটেড। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল নেটওয়ার্ক পরিসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৭ সালে টেলিকম মালয়েশিয়া ইন্টারন্যাশনাল (বাংলাদেশ) নামের সংস্থাটি একটেল নামে দেশে কার্যক্রম শুরু করে। ২০১০ সালে সংস্থাটি নাম পরিবর্তন করে রবি আজিয়াটা লিমিটেড হয়। ২০১৬ সালের নভেম্বরের পর থেকে রবি আজিয়াটার মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের আওতায় ‘রবি’ এবং ‘এয়ারটেল’ নামে পরিসেবা দিচ্ছে।
২০২০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এই কোম্পানিটি এক সময় লোকসানের তালিকায় থাকলেও মহামারির মধ্যে মুনাফায় বড় ধরনের চমক দেখিয়েছে। কোম্পানিটির আর্থিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে ২০১৮ সালে মুনাফার দেখা পায়। ২০১৯ সালেও মুনাফা করে কোম্পানিটি। তবে মুনাফার পরিমাণ অনেক কমে যায়।
অবশ্য মহামারি করোনার মধ্যে ২০২০ সালে ভালোই ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠানটি। বছরটিতে রবি আজিয়াটার কর-পরবর্তী মুনাফা হয় ১৫৫ কোটি ৩৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা, যা আগের বছর বা ২০১৯ সালে ছিল ১৬ কোটি ৯০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এ হিসাবে মুনাফা বাড়ে ৮১৯ শতাংশ।
এদিকে সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসের (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩২ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৫ পয়সা। অর্থাৎ মুনাফা বেড়েছে ২৮ শতাংশ।
টেলিযোগাযোগ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভালো ব্যবসা করার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলের কোম্পানি সচিব মো. আবদুস সালাম খান বলেন, টেলিযোগাযোগ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বাড়ার মূল কারণ হলো মহামারি পরিস্থিতি। মহামারির কারণে ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আগে অফিসে বসে কাজ করতেন এমন অনেকে এখন বাসায় বসে কাজ করছেন। ফলে অনেক সময় ইন্টারনেটে থাকছেন। মোবাইল অপারেটরগুলোর গ্রাহকরাও প্রচুর ইন্টারনেট নিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, মানুষ এখন ইন্টারনেটের মজাটা বুঝতে পারছে। যেমন- আমি একটা নামজারি করবো। আগে এক অফিসে কতবার যেত হতো! এখন আমি অনলাইনে ঢুকে আবেদন করলাম, কেস নম্বর দিল। আবার ঢুকে দেখলাম ফাইল কোথায় আছে। আমাকে ফিজিক্যালি কোথাও যেতে হচ্ছে না। এখন নেটেই হয়ে যাচ্ছে। ফিজিক্যালি যেতে হলে কত সময় এবং অর্থের ব্যাপার ছিল। অনলাইনে হওয়ার কারণে আমার খরচ কমছে এবং দ্রুত হচ্ছে। এজন্য ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করতে হচ্ছে। আইটিনির্ভর হয়ে এখন দেশও অনেক এগিয়ে যাচ্ছে।
আবদুস সালাম খান বলেন, আগামী ১২ ডিসেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভ-জি চালু হবে। এতে ব্যান্ডউইথের ব্যবহার অনেক বেড়ে যাবে। কারণ ফাইভ-জি চালু হলে সবাই চেষ্টা করবে এটা কেমন, দেখার জন্য। তখন মজা পেয়ে গেলে ব্যবহার আরও বেড়ে যাবে।
যোগাযোগ করা হলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল এবং ফাইভ-জি চালুর বিষয়টি আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আছে। আমরা তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের চুক্তি সই করেছি। আগামী ১২ ডিসেম্বর (রোববার) ঢাকা শহরের কিছু জায়গায় টেলিটকের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভ-জি চালু করবো। আগামী বছরের মার্চে তরঙ্গ নিলাম হবে। আশা করবো তরঙ্গ নিলামের পর বেসরকারি অপারেটররা ফাইভ-জি ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখবে। আমরা ২০২২ সালের মধ্যে একটা কনজুমার লেভেল পর্যন্ত ফাইভ-জি ব্যবহার করার মতো অবস্থায় যেতে পারবো বলে আশা করছি।