নোবেল জয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের অবস্থা আর আগের মতো নেই। প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে সরে যাওয়ার পর থেকেই নাজুক হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের মুনাফা কমছে। যা কমতে কমতে প্রায় শূণ্যের কোঠায় ঠেকেছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। দারিদ্ বিমোচনে অবদান রাখার জন্য ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। তবে অনিয়মের অভিযোগ এনে ২০১১ সালে ব্যাংক থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অব্যাহতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আইনী লডাইয়ে হেরে অবশেষে একই বছরে পদত্যাগ করেন তিনি। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফায় ব্যাপক পতন লক্ষ্য করা যায়।
২০১২ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের মুনাফা হয় ১৪৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যা নিয়মিতভাবে কমতে কমতে ২০১৫ সালে হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ হিসাবে ৩ বছরের ব্যবধানে মুনাফা কমেছে ১৪৩ কোটি ১০ লাখ বা ৯৮.৩৫ শতাংশ।
এদিকে, গ্রামীণ ব্যাংকে ২০১২ সালের ১৪৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার মুনাফা ২০১৩ সালে কমে হয়েছে ১৩৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। যা ২০১৪ সালে আরও কমে দাঁড়ায় ৪৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এ হিসাবে আগের বছরের তুলনা করলে ব্যাংকটি মুনাফায় সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে ২০১৪ সালে।
বিগত ৩ বছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় ও ব্যয় বেড়েছে। তবে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এটির মুনাফায় এ ধস নেমেছে।
দেখা গেছে, ব্যাংকটি ২০১২ সালে (প্রভিশনিং পূর্বে) ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা আয় করে। যা ২০১৩ সালে ৯ শতাংশ বেড়ে হয় ২ হাজার ৭২১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ৭ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৯০২ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং ২০১৫ সালে ৮ শতাংশ বেড়ে ৩ হাজার ১৩৫ কোটি ২০ লাখ টাকা আয় হয়।
এদিকে, ২০১২ সালে ব্যাংকটির মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩৫৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যা ২০১৩ সালে ১০ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৫৮৮ কোটি ১০ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ১০ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৮৫৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ বেড়ে হয় ৩ হাজার ১৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা দাঁড়িয়েছে।
মুনাফার সঙ্গে প্রতিবছর গ্রামীণ ব্যাংকে কর্মীর সংখ্যাও কমছে। ব্যাংকটিতে ২০১২ সালে ২২ হাজার ২৬১ জন কর্মী ছিল। যা ২০১৩ সালে ৪১০ জন কমে দাঁড়ায় ২১ হাজার ৮৫১ জনে। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ৪৪ জন ও ২০১৫ সালে ৭৬৪ জন কর্মী কমেছেন।
গত ৩ বছরে ব্যাংকটির শাখার সংখ্যা প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০১২ সালে এটির ২ হাজার ৫৬৭টি শাখা ছিল। যা ২০১৫ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৬৮টি। অর্থাৎ, এ সময় প্রতিষ্ঠানটির ১টি মাত্র শাখা বেড়েছে। এ হিসাবে ব্যবসায় সম্প্রসারণ হয়নি।
২০১৫ সাল শেষে ব্যাংকটিতে গ্রাহকদের ১৯ হাজার কোটি টাকার ডিপোজিট বা আমানত রয়েছে। এর বিপরীতে ব্যাংকটির ১০ হাজার ১০৯ কোটি টাকার প্রদত্ত ঋণ রয়েছে।
ব্যাংকটিতে গ্রাহক বা সদস্য সংখ্যা নিয়মিতভাবে বাড়ছে। ২০১২ সালে ব্যাংকটিতে ৮৩ লাখ ৭৪ হাজার গ্রাহক ছিল। যা ২০১৫ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৮৮ লাখ ৭ হাজারে। এ হিসাবে ৩ বছরে গ্রাহক বেড়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার।
১ হাজার কোটি টাকার অনুমোদিত মূলধনের গ্রামীণ ব্যাংকে ২০১৫ সালে ৮৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধন রয়েছে। এ ছাড়া ২২ হাজার ৮৯ কোটি টাকার মোট সম্পদ রয়েছে। তবে দায় ব্যতীত ১ হাজার ৩৯ কোটি ১০ লাখ টাকার রিজার্ভসহ ১ হাজার ৭০২ কোটি টাকার নিট সম্পদ রয়েছে।
ব্যাংকটির মোট সম্পদের মধ্যে ২৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা রয়েছে। এ ছাড়া ১০ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা নগদ, ১৫১ কোটি ৩০ লাখ টাকার স্থায়ী সম্পদ, ১০ হাজার ১০৯ কোটি টাকার প্রদত্ত ঋণ এবং ১ হাজার ১৬০ কোটি ৮০ লাখ টাকার অন্যান্য সম্পদ রয়েছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত সচিবের বরাবর ই-মেইল করার জন্য বলে। এর আলোকে গত ১৩ জুন মেইল করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সর্বশেষ মেয়াদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন না নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছিলেন এবং অবসরের বয়সসীমা না মানার অভিযোগে ২০১১ সালের মার্চে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংক অব্যাহতি দেয়। এর বিরুদ্ধে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ৯ জন পরিচালক দু’টি রিট মামলা করেছিলেন। দু’টি রিট আবেদনই খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশ বহাল রাখেন। ড. ইউনূস হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আপিল বিভাগে একটি আবেদন করেন। আপিল বিভাগ সেটিও খারিজ করে দেয়। পরবর্তীতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০১১ সালের ১২ মে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ‘ইস্তফা’ দেন।