বগুড়ায় সদ্য এসএসসি পাস এক ছাত্রীকে কলেজে ভর্তি করানোর কথা বলে বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকারের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, পরে স্থানীয় এক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সহযোগিতায় উল্টো মেয়েটিকেই এ ঘটনার জন্য দায়ী করে বিচারের নামে নির্যাতিতা ও তার মাকে ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। এরপর তাদের এলাকা ছাড়া করার জন্য এসিড মারার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ১৭ জুলাই ঘটা ধর্ষণের ওই ঘটনার পর শুক্রবার (২৮ জুলাই) দুপুরে তাদের চুল কেটে দিলে নির্যাতিতরা থানায় মামলা করেন। এরপর শুক্রবার রাতেই ধর্ষক হিসেবে অভিযুক্ত বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার (২৮)সহ তার তিন সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বগুড়া সদর থানার ওসি এমদাদ হোসেন জানান, ‘শনিবার (২৯ জুলাই) দুপুরে কিশোরীর মা সদর থানায় তুফান, তার আত্মীয় সংরক্ষিত আসনের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অপহরণ, ধর্ষণ ও অন্যান্য ধারায় মামলা করেছেন।’ তিনি জানান, ‘গ্রেফতার চারজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণ ও নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছে। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’
গ্রেফতার হওয়া অপর আসামিরা হলো তুফান বাহিনীর সদস্য কসাইপাড়ার দুলু আকন্দের ছেলে আলী আজম দিপু (২৫), খান্দার সোনারপাড়ার মোখলেসার রহমানের ছেলে আতিক (২৫) ও কালিতলার জহুরুল হকের ছেলে রুপম (২৪)।
বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী জানান, ‘যতই প্রভাবশালী হোক আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাউন্সিলর রুমকি ও অন্য আসামিরা গ্রেফতার হবে।’
তিনি আরও জানান, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তুফান ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ ও অন্যরা সহযোগিতার কথা স্বীকার করেছে। তুফানের বিরুদ্ধে একটি মাদক আইনের মামলা বিচারাধীন রয়েছে।’
মামলা সূত্রে জানা গেছে তুফান সরকারের আত্মীয় বগুড়া পৌরসভার ২ নম্বর সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি শুক্রবার (২৮ জুলাই) বিচারের নামে উল্টো ভিকটিম ও তার মাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে তুফান বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে নির্যাতন চালিয়েছে। নাপিত ডেকে এনে দুইজনের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। এরপর তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে বগুড়া ত্যাগে এসিড মারার হুমকিও দেওয়া হয়। এমনকি মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে বাড়িতে পিকআপ ভ্যান পাঠানো হয়েছিল।
শুক্রবার (২৮ জুলাই) দুপুরে প্রতিবেশীরা জানার পর মা ও মেয়েকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের ফিমেল সার্জারি বিভাগে ভর্তি করান।
শনিবার দুপুরে শজিমেক হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতর ওই ছাত্রী জানান, ‘সে এ বছর এসএসসি পাস করেছে। ফল ভালো না হওয়ায় কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে চিন্তিত ছিল। বাসার বাইরে গেলে তুফান ও তার লোক দিপু তাকে উত্ত্যক্ত করতো। রিকশা থামিয়ে তার কাছে ফোন নম্বর চাইতো। এক পর্যায়ে তুফান ও দিপু তাকে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। সে তাদেরকে কাগজপত্র ও ৪ হাজার টাকা দেয়। গত ১৭ জুলাই তুফান তাকে ভর্তির কাগজপত্রে স্বাক্ষর দেওয়ার নামে তার চকসূত্রাপুরের বাড়িতে ডেকে পাঠায়। ছাত্রীটি যেতে না চাইলে তাকে চালক জিতুকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে বাড়িতে নেওয়া হয়। স্ত্রী আশা খাতুন বাড়িতে না থাকায় তুফান ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। এ সময় তার সহযোগী মুন্না, জিতু ও আতিক পাহারা দেয়। এরপর মেয়েটিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বা অন্য কাউকে জানালে বাড়িতে ককটেল মারার হুমকি দেয়। লোকলজ্জা ও সন্ত্রাসীদের ভয়ে সে তাৎক্ষণিকভাবে ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে পারেনি।’
নির্যাতিতা ছাত্রীটি আরও জানান, ‘তুফানের সহযোগী আতিকের মাধ্যমে তুফানের স্ত্রী আশা খাতুন ঘটনাটি জানতে পারেন। এরপর তিনি তুফানকে এ ঘটনার জন্য দায়ী না করে উল্টো তার ওপর ক্ষিপ্ত হন। এরপর তার (আশা) বোন বগুড়া পৌরসভার ২ নম্বর সংরক্ষিত আসনের (৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড) আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি ও মা রুমি খাতুনের সহায়তায় তার বিচার করার পরিকল্পনা করেন। তিনি (ভিকটিম) ও তার মা বাড়িতে না থাকায় ওয়ার্ড কমিশনার রুমকি বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) তাদের ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেয়। শুক্রবার (২৮ জুলাই) দুপুরের দিকে তারা বাড়িতে ফিরলে কাউন্সিলর রুমকি তাদের দুইজনকে তার বাদুড়তলার নিজের বাসায় ডেকে নেন। এসময় রুমকি, আশা ও তাদের মা রুমা খাতুন ছাড়াও তুফান বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য ছিল।
ছাত্রীটি জানান, ‘এসময় তারা ধর্ষণের ঘটনার জন্য উল্টো আমাকেই দায়ী করে। এক পর্যায়ে কাউন্সিলর রুমকি প্রকাশ্যে আমার গায়ে হাত দেয় এবং আমার মাসহ আমাকে মারধর করার জন্য বাকিদের নির্দেশ দেয়। তার নির্দেশ পেয়ে অন্য ক্যাডাররা আমাদেরবেধড়ক মারধর করে। আমরা তখন তাদের হাতে পায়ে ধরেছিলাম। কিন্তু, তাও রুমকির দয়া হয়নি। তিনি কাঁচি দিয়ে আমাদের চুল কেটে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এতেও কাউন্সিলর রুমকি, তার বোন আশা সন্তুষ্ট হয়নি। এরপর তারা নাপিত ডেকে মাসহ আমার মাথা ন্যাড়া করে দেয়।’
নির্যাতিতা কাঁদতে কাঁদতে জানান, ‘এরপর পৌরসভার কাউন্সিলরের প্যাডে জোর করে আমাদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়। তারা মারধর করে উল্টো আমাদের ইয়াবা ট্যাবলেট দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। এরপর আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে বগুড়া ত্যাগ করার নির্দেশ হয়। নাহলে তুফান বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে এসিড মারার হুমকি দেয়।’
নির্যাতিতা আরও জানান, কাউন্সিলর রুমকি ও অন্যরা এসময় তাদের হুমকি দিয়ে বলে তারা সরকারি দলের লোক। পুলিশ প্রশাসন তাদের হাতের মুঠোয়। তাই কেউ তাদের কিছু করতে পারবে না। পরে বাসায় পিকআপ পাঠিয়ে তাদের মালপত্র তুলে অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়।
শজিমেক হাসপাতাল ও সদর থানায় গিয়ে দেখা গেছে, তুফানকে গ্রেফতার করা হলেও তারই লোকজন ওই ছাত্রী ও তার মাকে পাহারা দিচ্ছেন। তারা শনিবার (২৯ জুলাই)দিনভর তারা সদর থানা ও শজিমেক হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের আশপাশে অবস্থান নিয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চকসূত্রাপুরের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার জেলা যুবলীগের নেতা মতিন সরকারের ছোট ভাই। এ পরিবারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তুফান সরকার ও তার বাহিনী বগুড়ায় চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলোও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। দৈনিক চাঁদা ছাড়াও প্রতিটি গাড়ি থেকে এককালীন দেড় হাজার করে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগও আছে তুফানের বিরুদ্ধে। অনেক গাড়ির পেছনে লাগানো প্লেটে তুফানের নামও লেখা আছে। প্রশাসন তার মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির বিষয়টি জানলেও অজ্ঞাত কারণে কোনও ব্যবস্থা নেয় না। অভিযোগ রয়েছে, তারা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের মাসোহারা দেওয়ার বিনিময়ে অপরাধ করে থাকে।