ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়, জায়গা দখলের জন্য একটি পরিবারকে নির্যাতন করাসহ নানা অভিযোগ ওঠায় এক উপপরিদর্শককে (এসআই) প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রত্যাহার করা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ওই এসআইয়ের নাম তারেক সুমন। গত সোমবার রাতেই তাঁকে জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন জানান, এসআই তারেক সুমনের বিরুদ্ধে এর আগে আসা অভিযোগগুলো এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত অভিযোগগুলোর তদন্ত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
অন্যদিকে পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, তারেক সুমনকে অন্য রেঞ্জে পাঠিয়ে দেওয়ার (রেঞ্জ আউট) পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।
গত সোমবার গণমাধ্যমে ‘২ লাখ টাকা না দিলে আধঘণ্টার মধ্যে ক্রসফায়ার’ শিরোনামে এসআই তারেক সুমনের নানা অপকর্মের বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান তাঁকে ক্লোজ করার নির্দেশ দেন।
এসআই তারেক সুমনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ এবং আদালতে মামলা হয়েছে দুটি ঘটনায়। মাদক ব্যবসায় মদদ দেওয়া এমন পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে গত ২০ জুন সদর উপজেলার চিনাইর গ্রামের আতাউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দেন এসআই তারেক সুমন ও যুবরাজ নামে একজনের বিরুদ্ধে।
অভিযোগে বলা হয়- গোলাম রহমান ও আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী, শামসুদ্দিন চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ও আবদুল কাহার চৌধুরীর কাছ থেকে ১৯৮৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৯ শতক জমি কেনেন আতাউর। এরপরই ঘরবাড়ি করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। বাংলাদেশ জরিপামলে এসএ ১২৮০ দাগ, বিএস ৩৬২৫, ৩৬২৮ ও ৩৬৩৩ দাগে এই জমি লিপিবদ্ধ হয়।
তবে আতাউরের নামে বিএস খতিয়ান লিপি না হওয়ায় বিএস খতিয়ান সংশোধনের জন্য ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল আদালতে (এলএসটি মামলা নং-২০৭/২০১৬ ইং) তিনি একটি মামলা করেন; যা বর্তমানে বিচারাধীন।
এই জায়গাটি দখল করার চেষ্টায় চিনাইর গ্রামের আবদুল হাইয়ের ছেলে জাহাঙ্গীর, জিল্লু রহমান ভূইয়ার ছেলে হামিদুল ভূইয়া, সামসু ভূইয়ার ছেলে আলম ভূইয়া, লাল মিয়ার ছেলে শাহ আলম ও ঘাটিয়ারা গ্রামের মোবারক পুলিশ দিয়ে আতাউরের ওপর নির্যাতন করাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। জানান, ধারাবাহিকভাবে চলছে পুলিশি নির্যাতন। জায়গাটি লিখে না দেওয়ায় মাদক ও ডাকাতি মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয় তাঁকে। ছয় মাস জেল খেটে সম্প্রতি বেরিয়ে আসেন তিনি। এখন আবার পুলিশ তাঁকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
এর মধ্যে গত ৮ জুন এসআই তারেক সুমন পুলিশ দল নিয়ে আতাউরের বাড়িতে হানা দেন। এই সময় বাদী ও তাঁর স্ত্রীকে না পেয়ে তারেক গুলি করে মারার হুমকি দিয়ে আসেন।
অন্যদিকে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা আদায় করার অভিযোগে এসআই তারেক সুমনের বিরুদ্ধে ২০ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা করেন মুক্তিযোদ্ধা হামদু মিয়া। এই মামলায় আরো তিনজন পাঘাচং বড়বাড়ির সোলেমান মিয়া, সরকারবাড়ির নুরুল ইসলাম, আটলার আনু মিয়াকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৫ মার্চ হামদু মিয়ার ছেলে সালাহ উদ্দিন বিদেশ থেকে দেশে আসেন। দেশে আসার পর তিনি আত্মীয়স্বজনকে উপহার ও টাকা-পয়সা দেন এবং গরিব মানুষদের দান-খয়রাত করেন। এ বিষয়টি আসামিদের দৃষ্টিতে পড়ে। ১৬ এপ্রিল বিকেলে সালাহউদ্দিন চানপুর রেলব্রিজে বসে গল্পগুজব করার সময় এসআই তারেক সুমন সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁকে ধরে টেনেহিঁচড়ে চানপুর বাজারে এনে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেন। এরপর কোড্ডা ব্রিজের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁকে নামায়। এ সময় তারেকের সঙ্গে অস্ত্রধারী আরো ছয়জন ছিল। তারেকসহ এরা নিজেদেরকে গোয়েন্দা পুলিশ বলে পরিচয় দেয়। তারা সালাহ উদ্দিনের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে আধ ঘণ্টার মধ্যে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। সালাহ উদ্দিন তার পিতাকে ফোনে এই খবর জানালে মুক্তিযোদ্ধা হামদু মিয়া ও পরিবারের অন্য সদস্যরা দ্রুত তারেক সুমনের নির্দেশিত স্থান চানপুর বাজার রেলগেটে পৌঁছায় টাকা নিয়ে। সেখানে টাকা গ্রহণ করে সালাহ উদ্দিনকে ছেড়ে দেয় এবং নিজেদের মধ্যে টাকা ভাগভাটোয়ারা করে চলে যায়।
এই মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর মাসুদ আলম জানান- মামলাটির তদন্ত শেষ হয়নি। তবে তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
তারেক সুমন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় এএসআই হিসেবে যোগদান করেন ২০১৪ সালের ১৬ মার্চ। এসআই হিসেবে পদোন্নতির পর একই থানায় তাঁর পোস্টিং হয়।
এদিকে তারেক সুমনের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে এমন দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
বুধবার দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সামনে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সচেতন ছাত্র সমাজ নামে একটি সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার সাকিব। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সদস্য নাফিস মোহাম্মদ, সাব্বির রহমান, জুয়েল মিয়া প্রমুখ।
মানববন্ধন থেকে তারেক সুমনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানানো হয়।