জটিল এক আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে সামগ্রিক রাজনীতি। কি হবে, কি ঘটতে যাচ্ছে, কি আছে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভাগ্যে- সবই ঘোর অনিশ্চয়তায় ভরা। রাজনীতির অঙ্গণে আর অন্দর মহলে এসব নিয়ে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। আছে নানা মেরুকরণের আভাস, আছে আশার গল্প। আবার শঙ্কা জাগানো সমীকরণের আলোচনাও কম নেই পর্দার আড়ালের এসব আড্ডার আলাপচারিতায়। তবে একটি বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই, তা হল- যা কিছুই হোক, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই এক বছর সময়টা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ অধ্যায়।
এই দোলাচলটা তুলনামূলকভাবে ক্ষমতাসীনদের চেয়ে বিএনপি ও তাদের মিত্রমহলে বেশি। বিএনপি ও এই ঘরানার চিন্তকদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কান পাতলে শোনা যায়, ‘আর যা-ই হোক, ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারির ধাঁচের নির্বাচন আবার করা সম্ভব হবে না, নির্বাচন করতে হলে অংশীদারমূলক-ই করতে হবে’। নানা যুক্তি দেখিয়ে এই ভাবনায় এক ধরনের আশার আলো দেখছে মহলটি। তিন মাস লন্ডন সফর শেষে দেশে ফেরার পর রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উখিয়া যাওয়ার পথে ব্যাপক লোক সমাগমে অনেকটা উজ্জীবিত হতে দেখা গেছে এতদিন ধরে ছন্নছাড়া থাকা দলটির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের। কিন্তু এই উজ্জীবিত ভাব আবার মিইয়ে যাচ্ছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সম্ভাব্য পরিণতির দুশ্চিন্তায়। যে দুশ্চিন্তার কথা খোদ বিএনপি প্রধান নিজেই বৃহস্পতিবার আদালতে বলেছেন।
বিএনপির আশা ও শঙ্কার দোলাচল নিয়ে আলাপ হয় বিএনপির এমন একজন ভাইস-চেয়ারম্যানের সাথে, যিনি দলটির অনেক নীতি-নির্ধারণেও নেপথ্যে ভূমিকা রাখেন। তার মতে, ক্ষমতাসীনরা উভয় সংকটে আছে। দেশের ভেতরের ও বাইরের প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে দশম সংসদের মতো আরেকটা নির্বাচন করা সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আবার মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও ফল কি হতে পারে সেটিও অনুমেয়। এই অবস্থায় সরকারও হয়তো বিকল্প পথ খুঁজতে পারে।
একাদশ নির্বাচন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, যদি মোটামুটি সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশও না পায় তাহলে জেনেশুনে বিরোধী দলের আসনে বসার জন্য বিএনপি কেন নির্বাচনে যাবে? যদি এটাই হতো তাহলে তো পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনেই বিএনপি অংশ নিতো। কাজেই জেনেশুনে তলোয়ারের নিচে বিএনপি গলা পেতে দেবে-এমনটা চিন্তা করা ঠিক নয়। নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলার পর এই নেতার মন্তব্য, পাঁচ জানুয়ারির মতো নির্বাচন দেশে আর হচ্ছে না, নির্বাচন হতে হলে সবার অংশগ্রহণেই হতে হবে, সেজন্য ন্যূনতম পরিবেশও থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে বিএনপি অবশ্যই নির্বাচনে যাবে।
বিএনপির এই নেতার কথার মিল পাওয়া যায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথায়ও। ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ এখন মুখে যা-ই বলুক না কেন, সবার অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে সরকারকে শেষ পর্যন্ত একটা সমঝোতায় আসতেই হবে। কারণ এই বার্তাটি পরিষ্কার যে, দেশে আর পাঁচ জানুয়ারির মত নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও আদালতে দেয়া বক্তব্যে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সমঝোতার কথা বলেছেন।
তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে সমঝোতায় সায় নেই ক্ষমতাসীনদের। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যারা সংঘাতের উস্কানি দেয় তাদের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে না। ওবায়দুল কাদের এই প্রতিবেদকের সঙ্গেও আলাপকালে বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে তো সমঝোতার কিছু নেই। নির্বাচন কখন, কীভাবে, কার অধীনে হবে-সেটা সংবিধানেই পরিষ্কার করে বলা আছে। সুতরাং সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে।
প্রায় অভিন্ন বক্তব্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমেরও। তিনিও বললেন, বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা দূরে থাক, কোনো আলোচনাও হবে না। ভোটের আগে আলোচনা হবে জনগণের সঙ্গে। সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচন আগামী বছরের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এবারের নির্বাচনে বিএনপি আসবে, না এলে রাজনীতির মাঠ থেকে দলটি বহুদূরে ছিটকে পড়বে।
সমঝোতায় এখন পর্যন্ত সায় না থাকলেও খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি এবং ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে বিপুল জনসমাগমের বিষয়টিও নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগকে। মুখে ভিন্ন কথা বললেও আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়া মাঠে নামলে বিএনপির শক্তিমত্তা কি দাঁড়ায়- এই দুটি ইভেন্টে সেটি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে ক্ষমতাসীনরা। এই ধারণা থেকে আসন্ন ছয় সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে আওয়ামী লীগ। তবে সংসদ নির্বাচনের কর্মকৌশল চূড়ান্ত হবে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলাসমূহের গতিপ্রকৃতির উপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে, বিএনপিও খালেদা জিয়ার মামলার পরিণতি দেখে নির্বাচন ও আন্দোলনের ছক আঁকবে বলে দলটির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা জানান, খালেদা জিয়া মুক্ত থাকলে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারলে এক ধরনের কর্মকৌশল নেবে বিএনপি। আর ভিন্ন কিছু হলে কর্মকৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হবে। তবে খালেদা জিয়া মুক্ত না থাকলে দলের উপর বড় ধরনের ঝড় বইতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেও পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে জানিয়ে দলটির এই নেতা বলেন, খালেদা জিয়া লন্ডনে পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনায় সম্ভাব্য সব ধরনের বিকল্প মাথায় রেখে আগামীর কর্মপরিকল্পনার খসড়া করে রেখেছেন।
এদিকে, দেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছুটি শেষে অস্ট্রেলিয়া থেকে সহসাই দেশে ফিরতে পারেন বলেও গুঞ্জন উঠেছে। তিনি দেশে ফিরলে পরিস্থিতি কি দাঁড়ায়, সেদিকেও রাজনীতির উত্সুক চোখ রয়েছে। খালেদা জিয়ার মামলার গতিপ্রকৃতিও ডিসেম্বর নাগাদ একটা কাঠামো পেতে পারে। এই দুটি বিষয়, সামগ্রিক রাজনীতি, আগামী নির্বাচন ও নানা মহলে আনুষঙ্গিক নানা কথাবার্তার সমন্বয় করে রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিসেম্বর থেকে আগামী এক বছরের গতিপ্রবাহ ক্ষণে-ক্ষণে পাল্টে যেতে পারে।
এর সঙ্গে একমত পোষণ করে সরকারি জোটের শরিক ও ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন বুধবার ঢাকায় জেল হত্যা দিবসের এক আলোচনায় বলেছেন, ‘আগামী বছরটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই বছরেই নির্ধারণ হবে-বাংলাদেশ কোনদিকে যাবে। উন্নয়ন ও মধ্য আয়ের দেশের দিকে যাবে, না-কি ধ্বংসযজ্ঞ ও অর্থনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থার দিকে যাবে। অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন ধরে রাখতে হলে আগামী বছরটায় আমাদের (১৪ দলের) ঐক্য সংহত করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’