নিজস্ব প্রতিবেদক : আজ ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা থ্রি নট থ্রি আর এসএলআরের ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করে। ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাথে রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিপাগল আপামর জনতা। দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেদিনের সাহসী সস্তানরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। পাক হানাদার ও তাদের দোসররা মা-বোনের ইজ্জত হরণ করেছিল। ধ্বংস করতে চেয়েছিল বাঙ্গালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে। শত্রুর বুলেটের এত সব আঘাত সহ্য করেও সাতক্ষীরার সন্তÍানরা অন্ততঃ ৫০টি যুদ্ধের মোকাবেলা করেছিল। সাতক্ষীরার মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে হিং¯্র বিরোধিতাকারীদের ৪ জনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাবুনালে মামলা হয়েছে। হত্যা, ধর্ষণসহ ৭টি অভিযোগে সাতক্ষীরার কুখ্যাত রাজাকার জেলা জামাতের আমির খালেক ম-ল, আব্দুল্লাহিল বাকী, খান রোকনুজ্জামান ও জহিরুল ওরফে টিক্কার বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে। এদের মধ্যে খালেক ম-ল ও বাকিকে আটক করা হয়েছে। অন্য দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এমনকি আদালত কর্তৃক ডেইলি স্টার ও জনকণ্ঠ পত্রিকার আসামি হাজির হওয়ার বিজ্ঞপ্তিও জারি করা হয়েছে। জহিরুল ওরফে টিক্কা ২০১৩ সালের নাশকতার পর থেকেই আত্মগোপনে আছে। অন্যদিকে সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল নবজীবন ইন্সটিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক খান রোকনুজ্জামান দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। তদন্ত চলাকালীন সময়ে এক পর্যায়ে সে আত্মগোপন করে। চার্জশিট প্রদানের পর আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় রোকনকে ধরতে আজ পর্যন্ত কোন পুলিশি অভিযান পরিচালনার খবর সাতক্ষীরাবাসী শোনেনি। কি এক অদৃশ্য কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ এ ব্যাপারে নিরব থেকেছে। জনশ্রুতি আছে রোকনকে তার পরিবার বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পেরেছে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই। যুদ্ধাপরাধ মামলার সাক্ষীরাই বরং উদ্বেগের সাথে দিন কাটান। তাদের নিরাপত্তায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের রহস্যময় নিষ্ক্রিয়তা সাক্ষী ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের মনে ক্রমেই আশংকার সৃষ্টি করছে।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সাতক্ষীরা শহরে পাকিস্তান বিরোধী মিছিলে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে শহিদ আব্দুর রাজ্জাককে। আর এখান থেকে শুরু হয় সাতক্ষীরার দামাল ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া। মুক্তিযুদ্ধের খরচাদি বহনের জন্য সাতক্ষীরা ট্রেজারি হতে অস্ত্র আর ন্যাশনাল ব্যাংক হতে অলংকার টাকা পয়সা লুটের মধ্য দিয়ে শুরু মুক্তির সংগ্রাম। ৮ম ও ৯ম সেক্টরের অধীনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং শেষে ২৭ মে সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয় । এ সময় পাক সেনাদের ২ শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। ১৭ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে শহিদ হয় ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয় আরো ২ জন মুক্তিযোদ্ধা। এরপর থেমে থেমে চলতে থাকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্ত হামলা। এসব যুদ্ধের মধ্যে ভোমরার যুদ্ধ, টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ, বৈকারী যুদ্ধ, খানজিয়া যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এ সব যুদ্ধে শহিদ হয় ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। লাইটের আলোয় অসুবিধা হওয়ায় ৩০ নভেম্বর টাইম বোমা দিয়ে শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভীত সন্ত্রস্ত করে ফেলে পাক সেনাদের। রাতের আঁধারে বেড়ে যায় গুপ্ত হামলা। পিছু হটতে শুরু করে পাক সেনারা। ৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় টিকতে না পেরে বাঁকাল, কদমতলা ও বেনেরপোতা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে পাক বাহিনী সাতক্ষীরা থেকে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর জয়ের উন্মাদনায় জ্বলে ওঠে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা।
যারা শহিদ হন- মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শত্রুদের গুলিতে সাতক্ষীরার যে সকল বীর সন্তান শহিদ হন- তারা হলেন শহিদ আব্দুর রাজ্জাক, কাজল, খোকন, নাজমুল, হাফিজউদ্দিন, নুর মোহাম্মদ, আবু বকর, ইমদাদুল হক, জাকারিয়া, শাহাদাত হোসেন, আব্দুর রহমান, আমিনউদ্দিন গাজী, আবুল কালাম আজাদ, সুশীল কুমার, লোকমান হোসেন, আব্দুল ওহাব, দাউদ আলী, সামছুদ্দোহা খান, মুনসুর আলী, রুহুল আমীন, জবেদ আলী, শেখ হারুনার রশিদ প্রমুখ।
তবে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও সাতক্ষীরার বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজও। একই সাথে সাতক্ষীরা কালেক্টরেট চত্বরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত শহিদ স্মৃতি স্তম্ভে রাজাকারের নাম উল্লেখ থাকায় তা উদ্বোধন করা হয়নি। সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে যান না মুক্তিযোদ্ধারা। অযতেœ আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে বধ্যভূমি ও গণকবরের স্মৃতিচিহ্ন। এগুলো যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তাই বধ্যভূমি ও গণকবরের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন সাতক্ষীরার মুক্তিযোদ্ধারা।
সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোশারফ হোসেন মশু জানান, প্রতিবছর ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের আয়োজনের যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করা হয়। তিনি সাতক্ষীরার বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের দাবি জানান সরকারের কাছে। একই সাথে সাতক্ষীরা কালেক্টরেট চত্বরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত শহিদ স্মৃতি স্তম্ভে রাজাকারদের নাম মুছে সেটি উদ্বোধনের জোর দাবি জানান।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জানান, সাতক্ষীরার বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সাথে কালেক্টরেট চত্বরের শহিদ স্মৃতিস্মম্ভ নিয়ে বিদ্যমান বির্তক নিরসন করে তা অচিরেই উদ্বোধনের আশ্বাস দিলেন তিনি ।
আজ সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস ; উদ্যোগ নেই যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি গ্রেফতারের
পূর্ববর্তী পোস্ট