অনলাইন ডেস্ক: কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় একটি করে খাসি জবাই করা হয়। এ দিয়ে ওই দিনের ভোজ সারেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইবাদত হোসেন। খাসি একেক মাসে একেক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাধ্যতামূলকভাবে সরবরাহ করেন। এক বছর ধরে এটা চলছে।
সম্প্রতি দুস্থদের জন্য রবাদ্দ ত্রাণের টিন দিয়ে উপজেলা পরিষদ মসজিদের মার্কেট নির্মাণ করেছেন ইউএনও। শুধু টিন না, এই মার্কেটের ইট থেকে শুরু করে অন্য নির্মাণসামগ্রী তিনি বিভিন্নজনের কাছ থেকে নিয়েছেন। দাতাদের মধ্যে রয়েছে ভাটা মালিক, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও বিভিন্ন প্রকল্পের কমিটি (পিআইসি)। সাহায্য নিয়ে মার্কেটটি নির্মাণ করলেও এখন এর সব খরচ মার্কেটের বরাদ্দপ্রাপ্ত দোকান মালিকদের কাছ থেকে নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন। ইউএনও ওই মসজিদ কমিটির সভাপতিও। সাধারণ সম্পাদকসহ মসজিদ কমিটির কোনো সদস্য মার্কেট নির্মাণ সম্পর্কে কিছু জানেন না। মার্কেট নির্মাণের আগে-পরে এ নিয়ে কমিটির কোনো সভা-রেগুলেশন হয়নি।
উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণের জন্য গরু, ছাগল ও সেলাইমেশিন কেনার অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইউএনও ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে রোগা ও কম দামের গরু-ছাগল কিনে আনেন। বিতরণ করতে এসে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ক্ষুব্ধ হয়ে এসব ফেরত দিয়ে ভালো গরু-ছাগল কিনতে বলে চলে যান।
এদিকে এক ইউপি চেয়ারম্যানের টাকায় সরকারি অফিসে তাপানুকূল যন্ত্র (এসি) লাগিয়েছেন ইউএনও। যদিও তাঁর অফিসে চারটি সিলিং ফ্যান রয়েছে। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তিনি প্রচার চালান বেতনের টাকায় এসি লাগিয়েছেন। উপজেলা পরিষদের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কোনো ইউএনও এসি ব্যবহার করতে পারেন না। তাঁর বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, সম্প্রতি মোনহরদিয়া ইউনিয়নের একটি সড়ক থেকে কোটি টাকা মূল্যের ৪৬টি বড় গাছ কেটে আত্মসাৎ করেন। ২৫ বছর আগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) এই গাছ রোপণ করেছিল। এ নিয়ে এলজিইডি থানায় অভিযোগ দেয়। ইউএনওর চাপে থানা সেই মামলা নথিভুক্ত করেনি।
ভুক্তভোগীরা জানায়, ইউএনও ইবাদত হোসেন প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবারই গোপনে সরকারি গাড়ি নিয়ে তাঁর নিজ বাড়ি নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলার লাহড়িয়া গ্রামে যান। সম্প্রতি সেখান থেকে ফেরার পথে এক শুক্রবার দুপুরে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সীমান্তে মারাত্মক দুর্ঘটনায় তাঁর সরকারি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বিষয়টি বেমালুম চেপে গিয়ে জেলা প্রশাসনকে জানান, সরকারি কাজে গিয়েছিলেন।
এখানেই শেষ নয়। ভিক্ষুক পুনর্বাসনের নামে সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক দিনের বেতনসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া টাকা খরচের ব্যাপারে এ কর্মকর্তার স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এ ছাড়া টিআর, কাবিখা, সোলার স্থাপনসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ইউএনওর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান, বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জানান, ইউএনও প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা হয়েও তাঁর অফিসে সরকারবিরোধীদের নিয়ে নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। এ নিয়ে গত ১৪ ডিসেম্বর এক চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁর তর্ক হয়।
সম্প্রতি সদর উপজেলার আইলচারা ইউনিয়নের একটি বিদ্যালয়ের সামনে থেকে কিছু মাটি কেটে রাস্তায় দেয় শ্রমিকরা। এ ঘটনার পর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও স্থানীয় এক মেম্বারকে অফিসে ডেকে এনে তাঁকে লোকজনের সামনে গালাগাল করে মারতে উদ্যত হন ইউএনও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মেম্বার বলেন, ‘একটা ঘটনা নিয়ে ইউএনও আমাকে বকাঝকা করেছিলেন। মুখ বুজে সব সহ্য করেছি। ’
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা তাঁর অফিসে শৌচাগার নেই বলে তাঁকে জানাতে গেলে তিনি ওই কর্মকর্তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। নারী কর্মকর্তা কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা এক কৃষককে সার্টিফিকেট মামলায় জেলে পাঠান ইউএনও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইউএনওর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ইউএনও সবার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। বিষয়টি নিয়ে অনেকে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দিয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, বিভিন্ন সময় ইউএনও প্রধানমন্ত্রীর এক বিশেষ সহকারীর আত্মীয় ও আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার পরিচয় দিয়ে দাপট দেখান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুষ্টিয়ার এক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলেন, ‘ইউএনও যেভাবে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন তাতে সবাই হতবাক। তিনি উপজেলার সব দপ্তরের লোকজনকে সব সময় গালমন্দ করেন। এতে সবাই তাঁর ওপর বিরক্ত। তবে মুখ খুলে কেউ কিছু বলতে সাহস করে না। তিনি জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও সম্মান করেন না। তাঁকে নিয়ে আমরা সবাই খুবই বিব্রত। ’ ইউএনও ইবাদত হোসেনের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর কার্যালয়ে গেলে তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি। একপর্যায়ে তিনি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হাসান হাবিব বলেন, ‘ইউএনওর বিরুদ্ধে যদি এ ধরনের অভিযোগ আমাদের নজরে আসে, তাহলে তদন্ত করে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেব। ’
সূত্র: কালের কণ্ঠ।