প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পৃথিবীর দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির তালিকায় বেগম খালেদা জিয়া তিন নম্বর হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। খালেদা জিয়া কিন্তু প্রকাশিত এসব সংবাদের কোনো প্রতিবাদ জানাননি। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এ দেশের জনগণের সম্পদ আর লুটপাট, পাচার করতে দেওয়া হবে না। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জাতীয় সংসদের গতকালের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে ফজিলাতুন নেসার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী প্যারাডাইস পেপার কেলেঙ্কারির বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। ১৫৯ পৃষ্ঠাব্যাপী মুদ্রিত জবাবের বেশির ভাগই বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের অর্থের বিবরণ। এ ছাড়া প্যারাডাইস পেপার কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিবরণ তুলে ধরা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিয়া পরিবারের ধারাবাহিক দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বলেন, ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রভাব খাটিয়ে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে ২০০৬ সালের মধ্যে মাত্র ১৫ বছরে জিয়া পরিবার দেশে-বিদেশে অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। ভাঙা সুটকেস থেকে বেরিয়ে আসে জিয়া পরিবার। প্রধানমন্ত্রী দেশে জিয়া পরিবারের মালিকানায় থাকা ১৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তালিকা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অবৈধ উপায়ে গোপন আর্থিক লেনদেনের ফাঁস হওয়া নথি, যা প্যারাডাইস পেপার কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিত, সেখানেও এসেছে জিয়া পরিবারের নাম। তারেক রহমান ল ফার্ম অ্যাপলবাইর গ্রাহক। তিনি ১৯৯৩ থেকে ২০০৬ সময়কালে তার লন্ডনের ঠিকানায় ৮০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। আরাফাত রহমান কোকো অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাচার করেন। এ ছাড়া ল ফার্ম ওয়াকারের সহযোগিতায় তিনি ২০০২ সালের মার্চে কর ফাঁকি দেন এবং সিঙ্গাপুরে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার ও লেবাননে জিয়া পরিবারের অবৈধ সম্পদ ও বিনিয়োগের তথ্য পেয়েছে সৌদি দুর্নীতিবিরোধী কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি সৌদি আরবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার প্রিন্সদের জবানিতে বেরিয়ে এসেছে বেগম খালেদা জিয়া ও তার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর নাম। খালেদা জিয়াসহ পাঁচ বিদেশি নাগরিক ও ১৯ সৌদি নাগরিকের বিরুদ্ধে সৌদি আরবে দুর্নীতি তদন্ত শুরু হয়েছে। সৌদি আরবে জিয়া পরিবারের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ১২০০ কোটি টাকা। শেখ হাসিনা আরও জানান, সৌদি আরবের জনৈক আহমদ আল আসাদের নামে আরফা শপিং মলটির মালিক বেগম জিয়া। কাতারের টিপরা কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স ও কোকোর নামে ইকরা কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স ছাড়াও বিশ্বের ১২টি দেশে খালেদা-তারেকের ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অবৈধ সম্পদ রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, অতিসম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীর তালিকায় নাম উঠে আসে জিয়া পরিবারের। সংযুক্ত আরব আমিরাতে জিয়া পরিবারের প্রাক্কলিত সম্পদের পরিমাণ ১২০ কোটি দিরহাম, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার অর্থমূল্য ২ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক বিভাগের তথ্যভাণ্ডার ‘ফরেন ইনভেস্টরস ক্রাট ইউএই’-তে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ইউএই ও ভারতের যৌথ টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে দাউদ ইবরাহিমের ১৭০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মধ্যে তিনটি তারেক রহমানের সঙ্গে যৌথভাবে। তিনি বলেন, সম্পদের তালিকায় বাদ যায়নি তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমানের নামও। জাইমার নামে রিগ্যাল টাওয়ারে একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। যার মূল্য ৭ কোটি দিরহাম। এই সম্পদটি ২০০৪ সালে কেনা। এ ছাড়া দুবাইতে বেগম জিয়ার ভাই প্রয়াত সাঈদ ইস্কান্দারের নামে দুটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে। ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দারের নামেও দুবাইতে আছে একটি অ্যাপার্টমেন্ট, যার মূল্য ৭ কোটি দিরহাম। বড়বোন প্রয়াত খুরশিদ জাহান হক চটলেটের নামে এমিরেটস হিলে আছে একটি অ্যাপার্টমেন্ট, যার মালিকানা সম্প্রতি তার মেয়ে হাসিনা জাহানের নামে হস্তান্তর হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, সিঙ্গাপুরের ট্রেড ডেভেলপমেন্ট বোর্ড যে ১৮টি বিদেশি কোম্পানিতে অবৈধ সম্পদ আছে বলে সন্দেহ করছে, তার চারটিতেই জিয়া পরিবারের নাম জড়িয়ে আছে। তিনি আরও জানান, সিমেন্স ও চায়না হারবাল থেকে প্রয়াত আরাফাত রহমান যে ঘুষ নিয়েছিলেন, সেখান থেকে ২০১২ সালে ১৩ কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনে দুর্নীতি দমন কমিশন। শেখ হাসিনা আরও বলেন, ২০১২ সালে আরাফাত রহমান কোকোর পাচারকৃত ২০ লাখ ৪১ হাজার ৫৩৪ দশমিক ৮৮ সিঙ্গাপুরি ডলার সে দেশ থেকে ফেরত আনা হয়েছে। তারেক রহমান দেশের বাইরে প্রচুর অর্থ পাচার করেছেন। তারেক ও তার ব্যবসায়িক পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল মামুন যৌথভাবে একটি বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার বিনিময়ে প্রায় ২১ কোটি টাকার মতো সিঙ্গাপুরে সিটিএনএ ব্যাংকে পাচার করেন। এ ব্যাপারে শুধু বাংলাদেশ নয়, আমেরিকার এফবিআইও তদন্ত করেছে। এর সূত্র ধরে এফবিআইর ফিল্ড এজেন্ট ডেব্রা ল্যাপ্রিভোট ২০১২ সালে ঢাকায় বিশেষ আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। এ মামলায় হাই কোর্টে তারেক রহমানের সাত বছরের সাজা হয়। একই ভাবে লন্ডনের ন্যাট ওয়েস্ট ব্যাংকেও প্রায় ৬ কোটি টাকা পাওয়া গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও জানান, নতুন করে বেলজিয়ামে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ও মালয়েশিয়ায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, এ দেশের জনগণের সম্পদ আর লুটপাট ও পাচার করতে দেওয়া হবে না। এ ধরনের অপকর্ম তদন্তের মাধ্যমে উদ্ঘাটন এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনগণের পয়সা জনগণকে ফেরত দেওয়ার যেসব আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে তার ব্যবস্থা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি বা অন্য কোনো অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিয়মবহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে সরকারের সব সংস্থা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।
প্যারাডাইস পেপার কেলেঙ্কারিতে যাদের নাম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সংসদে পানামা প্যারাডাইস পেপার কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছেন— আবদুল আউয়াল মিন্টু, নাসরিন ফাতেমা আউয়াল, মোহাম্মদ তাবিথ আউয়াল, মোহাম্মদ তাফসির আউয়াল, পাথ ফাইন্ডার ফাইন্যান্স ও হ্যান্সিয়াটিক লিমিটেডের কাজী জাফরুল্লাহ, নিলুফার জাফরুল্লাহ, ইল্ডেস্টার লিমিটেডের কাজী রায়হান জাফর; কর্পেনিকাস ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের কফিল এইচ এস মুয়ীদ, মেহবুব চৌধুরী, অর্কন ইনোভেশনের মোহাম্মদ ইউসূফ রায়হান রেজা, ডায়নামিক ওয়ার্ল্ড হোল্ডিংয়ের ইশতিয়াক আহমেদ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল মার্কেন্টাইল সার্ভিস লিমিটেডের নোভেরা চৌধুরী, সনিস্কাই ইন্টারন্যাশনালের ফরহাদ গনি মোহাম্মদ, এশিয়ান ক্যাপিটাল ভেঞ্চারর্সের বিলকিস ফাতেমা জেসমিন, দ্য কমিউনিকেশন কোম্পানির রজার বার্গ, জেইন উপর, নোবেল স্ট্যান্ডার্ডের মোহাম্মদ আবুল বাশার, ডালিয়ান লেটেক্সের বেনজির আহমেদ, মোহাম্মদ মোকমেদুল ইসলাম, মোহাম্মদ মোতাজ্জারুল ইসলাম, বেস্ট নিট ইন্টারন্যাশনালের আফজালুর রহমান, ম্যাক্স স্মার্ট ইন্টারন্যাশনালের সুধির মল্লিক, জেদ উইন্ডের জীবন কুমার সরকার, পাইওনিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসের নিজাম এস সেলিম, এসটিএস ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের এম সেলিমুজ্জামান, সভেরিন ক্যাপিটালের সৈয়দ সিরাজুল হক, ক্যাপ্টেন এস এ জাউল, স্প্রিং সোর ইনকরপোরেটেডের এফ এম জোবায়দুল হক, সালমা হক; প্যারামাইন্ড রকের মোহাম্মদ আমিনুল হক, নাজিম আসাদুল হক, তারিক একরামুল হক, রিংস্টার প্রাইভেট লিমিটেডের মোহাম্মদ শাহেদ মাহমুদ, আজমত মঈন, খাজা শাহাদাত উল্লাহ, দিলীপ কুমার মোদী, দ্য কন্ট্রাক্ট অ্যান্ড সার্ভিসের সৈয়দ সামিনা মির্জা, মির্জা এম ইয়াহিয়া, গ্রাটানভিল লিমিটেডের মোহাম্মদ ফয়সাল করিম খান, পাথ ফাইন্ডারের জুলফিকার হায়দার; তালাভেরা ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইঙ্কের উম্মে রুবানা, মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, এন্ডারলাইট লিমিটেডের নজরুল ইসলাম, লাকি ড্রাগন ম্যানেজমেন্ট ইঙ্কের মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, বাংলা ট্রাক ও ব্যাকিংডেল লিমিটেডের জাফর উমীদ খান, ম্যাগফিসেন্ট ম্যাগনিট্যুড ইঙ্কের আসমা মোমেন, এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম, তাইতান এলায়েন্সের এ এফ এম রহমাতুল বারি, মেঘনাঘাট পাওয়ারের ফয়সাল চৌধুরী, ড্রাগন ক্যাপিটাল ক্লিন ডেভেলপমেন্ট ইনভেস্টমেন্টের আহমেদ সমীর।