অনলাইন ডেস্ক: ‘যারা মাধ্যমিকে রেজাল্ট খারাপ করবা আমার সাথে যোগাযোগ কর। ১০০% সিউর দিয়ে পাশ বা গোল্ডেন করিয়ে দিব। কোনো ঝামেলা হবে না। ১৫ তারিখ থেকে বোর্ড খাতা হস্থান্তর করা হবে। so যত তাড়াতাড়ি possible আমার সাথে meet কর। চাইলে তোমার পিতা-মাতা নিয়ে আমার বাসায় এসে কথা বলতে পার। তুমি চাইলে আমরাই তোমাদের বাসায় এসে তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলব।’ SADMAN CHOUDHURY BAPPY আইডি থেকে গত শনিবার দুপুরে ফেসবুকে দেওয়া নোটের অংশবিশেষ এটি। এত দিন ধরে যারা ফাঁস করা প্রশ্নের ব্যবসা করেছে তাদেরই অনেকে এখন ডালায় করে ফল বিক্রির মতো মাধ্যমিকের ‘ফল বিক্রি’ করছে। নিশ্চিত গোল্ডেন, জিপিএ ৫ বা ফেল বিষয়ে উত্তীর্ণ করার প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে পরীক্ষার্থীর প্রবেশপত্র, কেউ কেউ অভিভাবকের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও হাতিয়ে নিচ্ছে। তারপর বলা হচ্ছে, ‘টাকা দাও, না হলে ফেল করিয়ে দেব।’ এ ধরনের প্রতারণার ব্যাপারে বোর্ড কর্তৃপক্ষ সাবধান করে দিলেও অনেক পরীক্ষার্থী এই ফাঁদে পা দিচ্ছে।
বেশ কয়েকজন প্রতারকসহ একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে প্রতারণার আদ্যোপান্ত। প্রতারকদের এসব স্ট্যাটাসের (ফোন নম্বরসহ) কপি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ০১৭৯২৭৩৫৮৬২ নাম্বার দিয়ে ‘MD Rakib Khan’, ০১৭১৭৮৩৭০৬৭ নাম্বার দিয়ে ‘Bord Quasan Rujulte’, ০১৮৫০১৫৯৫০২ ও ০১৭৮৩২৮৫৬৯৪ নাম্বার দিয়ে ‘Md. Al-Amin Islam’সহ আরো অনেকে ফল পরিবর্তন করিয়ে দেওয়ার লোভ দেখাচ্ছিল। এ ফোন নাম্বারগুলোতে কথা বলে প্রতারণার বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়া গেছে। এসব নাম্বার দিয়ে মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র বিক্রি করারও অনেক প্রমাণ রয়েছে ফেসবুকে। Sudu Tomar Opekkay আইডি থেকে PSC JSC SSC HSC Degree Honours Masters Admission Test BCS Job Question Out গ্রুপে লেখা হয়, ‘পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তন করে পাস করে দেওয়া হবে। যারা ভালো পরীক্ষা দিছ, একটুর জন্য জিপিএ ৫ পাবা না, তারাও নিজের ইচ্ছামতো রেজাল্ট পরিবর্তন করতে পারবা। কারণ যারা বোর্ডে কাজ করে তারা এই কাজ টাকার মাধ্যমে করে দিতে পারে। কিছু শর্ত মেনে চললে তা সম্ভব। গোল্ডেন A+ জিপিএ ৫=৫০০০ টাকা, A ৪০০০ টাকা, শুধু পাস ৩০০০ টাকা। যোগাযোগ ০১৮৩২১৭০৬০২।’ গতকাল সন্ধ্যায় এই নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে একজন নিজেকে চট্টগ্রামের বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে বলেন, সিলেটের এক বন্ধুর মাধ্যমে তিনি এ কাজ করছেন।
BD Exam Helper আইডি থেকে গতকাল SSC ALL BOARD QUESTION OUT GROUP 2017 2018 SHAN AHOMED গ্রুপে লেখা হয় : ‘আপনি কি এসএসসি ২০১৮ এর রেজাল্ট পরিবর্তন এর কাজ করাবেন? আমরা ৪ বছর ধরে এই কাজে আছি। যারা রেজাল্ট এর আগেই কাজ দিয়ে রাখে তাদের রেজাল্ট সরাসরি বোর্ড থেকে পরিবর্তন করে দেই। কারণ রেজাল্ট হয়ে যাওয়ার পর আর কোনোভাবেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়! আমরা সরাসরি খাতার নাম্বার চেঞ্জ করিয়ে কাজ করে দেই! তাই কোনো রকম সমস্যা থাকে না। খরচ : গোল্ডেন এ+ ৭০০০ টাকা (গড়ে ৯০ মার্কস) ও এ+ ৫০০০ টাকা (গড়ে ৮০ মার্কস)। সব বিষয়ে গড়ে ৯৫ মার্কস চাইলে ৮০০০ টাকা। ৩ ভাগের ১ ভাগ টাকা পেমেন্ট করে কাজ দিতে হবে।’
মো. মাহাবুর হাসান আইডি থেকে ০১৭১০২৫৮৩৪৭ নাম্বারসহ দেওয়া স্ট্যাটাস ধরে গতকাল দুপুরেই কথা বলেন প্রতিবেদক। ‘মাহাবুর’ রাখঢাক ছাড়াই বলেন ১৮ হাজার টাকা দিলে তিনি ‘গোল্ডেন’ পাইয়ে দেবেন। এ জন্য আগে প্রবেশপত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও বাবার আইডি কার্ডের কপি দিতে হবে। অনেকে ১০ হাজার টাকায় পরিবর্তন করাচ্ছে বললে উত্তর দেওয়া হয়, ‘তাহলে যাও, টাকা দাও আর বাঁশ খাও। আমার কাজ জেনুইন, তাই টাকা বেশি।’ পরে প্রতিবেদক নিজের পেশাগত পরিচয় দিলে ওই প্রান্ত থেকে ফোন কেটে দেওয়া হয়। মাহাবুর বিজ্ঞাপনী স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘এসএসসি ও এইচএসসি বিগত চার বছর হতে রেজাল্ট চেন্জ করে আসছি। এখন বুকিং চলছে, যারা যারা রেজাল্ট চেন্জ করতে চাও তারা যোগাযোগ কর। ফোন ০১৭১০২৫৮৩৪৭। [বি: দ্র: এ রকম অনেক পোস্ট ফেসবুকে পাবা কিন্তু তোমরা আমার গ্রুপ ব্যতীত যদি অন্য কোথাও যোগাযোগ কর তাহলে এটুকু বলব যে বাঁশ খেতে হইবে।’
MD Rakib Khan-এর সঙ্গে কথা হয় আরো দুই দিন আগে। ব্যক্তিটি নিজেকে ঢাকা বোর্ডের চাকরিজীবী পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘তুমি যেই ফল চাও আমার অপারেটর অনলাইনে তা দেখিয়ে দেবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নথিপত্রের কোনো ডাটাই পরিবর্তন করা সম্ভব নয় এবং পরীক্ষার্থীকে এই ঝুঁকি মেনে নিয়েই ‘কাজ’ করাতে হবে।
এদিকে নাম গোপন রাখার শর্তে একজন পরীক্ষার্থী বলেছে, সেসহ কয়েকজন ‘Mithil Anjum Shawon’-এর প্রলোভনে পড়ে তার ইনবক্সে প্রবেশপত্র দেয় কিছু টাকায় ফল পরিবর্তন করা যাবে এ আশায়। ‘শাওন’ পাঁচ হাজার টাকা দাবি করছে, যেই সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থী অপারগতার কথা বলেছে, তাকে ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থী বারবার এ প্রতিবেদককে বলছিল, ‘ভাইয়া, ও কি সত্যিই ফেল করাতে পারবে?’
‘মিথিল’-এর ব্যবহৃত ০১৮১৫৭৮৭২০৩ ফোন নম্বরে গতকাল সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ বারবার এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘সামনে বাড়েন।’ এর আগে জেএসসির ফল পরিবর্তন করিয়ে দেওয়ার একাধিক প্রলোভনমূলক স্ট্যাটাসে ‘মিথিল’ ফোন নম্বরটি ব্যবহার করেন। তাঁকে প্রবেশপত্রর কপি দিয়ে এখন ভয়ে আছে এমন একজন পরীক্ষার্থী বলে, এই নম্বরেই মিথিল টাকা নেয় বিকাশে। ‘মিথিল’ PSC JSC SSC HSC Exam Helping Center গ্রুপে লিখেন, ‘যে সকল ছাত্র/ছাত্রীরা এইবার ংংপ পরীক্ষা দিচ্ছো তাদের জন্য সু-খবর। যাদের ২/৩ সাবজেক্ট-এ খারাপ হয়েছে। ফেল অথবা A+ আসবে না। অল্পের জন্য A+ ছুটে যেতে পারে। সম্পূর্ণ রেজাল্ট টাকে A+ বা Golden করে নিতে এখনে আমার সাথে যোগাযোগ করুন। (সময় সীমিত) অফিশিয়াল ভাবে রেজাল্ট চেঞ্জ করা হবে, পরবর্তীতে কোনো সমস্যা হবে না। সকল বোর্ডের কাজ করা হচ্ছে। ৬ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।’
মাধ্যমিকের গণিতের প্রশ্ন লাগলে ০১৭২৬৯৬৫২০২ নাম্বারে যোগাযোগ করতে কয়েক দিন আগে ‘শরিফা আক্তার লিজা’ ও ঝধষরস কযধহ আইডি থেকে বিজ্ঞাপনী স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। Salim Khan গতকাল Psc Jsc Ssc Hsc All Exam 100% Out Question & Suggestion গ্রুপে লিখেন, ‘ফেলকে পাস বা রেজাল্ট পরিবর্তন করতে দ্রুত ০১৭২৬৯৬৫২০২ নাম্বারে যোগাযোগ করো।’
আরো যেসব আইডি থেকে ফল বিক্রির প্রলোভন দেখানো হচ্ছে : PSC JSC SSC HSC Exam Helping Cente পাবলিক গ্রুপে বেপরোয়াভাবে ‘ফল বাণিজ্য’র চেষ্টা চলছে। গ্রুপটি পরীক্ষার্থীদের কাছেও জনপ্রিয়। গতকাল এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত সদস্য দেখাচ্ছিল এক লাখ ১৮ হাজার ৯৭৮। গত তিন চার দিন এখানে নজর রেখে যে আইডিগুলোকে ফল বাণিজ্যে বেপরোয়া দেখা গেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে Ovizet Ray-ফোন ০১৮৪০৫৭৬৩৪১, Niloy Ahmed-ফোন ০১৯৯৮৬৭১৬৪০, Tuhin Rahman ০১৭৭২৭৭৩৪৭২, Naimur Rahman Durjoy ০১৯৯৬০২০৬২৪। এই গ্রুপে ফোন নম্বর উল্লেখ না করে যারা ফল পরিবর্তনের ফাঁদ পাতছে তাদের আইডির মধ্যে আরো আছে Sk Raja, Sk Moshfiqur Khan, Nuruzzaman Nishan, Tanisha Jahan Mim, রিয়াদ সোহান, WaSan Ahmed, Sohel Rana, Samim Islam, Sudu Tomar Opekkay ও Amar Bhin Deshi Tara।
এ ছাড়া Ripon Hasan, ফোন ০১৭৬১১০৯০০৯, PSC JSC SSC HSC ALL BOARD QUESTIONS 100% COMMON গ্রুপে, Nirob Akash ফোন +৬০১১২০৫৩০৩৯৯, SSC HSC All Exam Question 2018 গ্রুপে, Anup Saha, ফোন ০১৭৯৬১৭২১৭৬, PSC JSC SSC HSC All Board Real Question 100% Real Help Line গ্রুপে, Honey Raj, ফোন ০১৭৭৪০৮৭০২০, SSC Question 2018 গ্রুপে স্ট্যাটাস দেওয়া হচ্ছিল ফল পরিবর্তনের প্রলোভন দেখিয়ে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহ্জাহান মাহমুদ বলেন, ‘মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের মতো অপরাধ যারা করছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে তাদের দেওয়া ফোন নম্বর ধরে খোঁজার কোনো অনুরোধ শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের করেনি। তবে কিছু ফেসবুক আইডি, পেজ ও গ্রুপ বন্ধ করতে আমাদের বলা হয়েছে। আমরা এ নিয়ে কাজ করছি।’ তিনি আরো বলেন, আর যারা এসব অপরাধ করছে তাদের ধরে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্বটি আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, ‘অনলাইনে নানা রকম ঘোষণা দিয়ে যারা বিভ্রান্ত করছে তাদের বেশির ভাগই ফেইক। এর মধ্যে যেগুলোর লিংক পাওয়া যাচ্ছে, সেসব সূত্র ধরে আমরা এগোচ্ছি।’ সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, যারা অনলাইনে নানা রকম প্রচারণা চালিয়ে প্রশ্ন ফাঁসসহ পরীক্ষা জালিয়াতি করছে, তারা পরস্পর সংযুক্ত। সবাই মিলেমিশেই অপরাধটি করছে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ।