দেশের খবর: মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা দিতে সরকারের নেওয়া একটি প্রকল্প বন্ধের উপক্রম হয়েছে। লুটপাটের সুযোগ না পেয়ে প্রকল্প কর্মকর্তার (পিডি) বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাকে সরানোর পর পুরো প্রকল্পটিই বন্ধের তৎপরতা চালায় একটি সিন্ডিকেট। তবে সিন্ডিকেটের এই তৎপরতা আঁচ করতে পেরে সরকারের অগ্রাধিকারে থাকা এই প্রকল্পটিকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০১৭ সালে এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা প্রচলন (২য় প্রকল্প)’ প্রকল্প শুরু করে সরকার। প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, মডেম ও সাউন্ডবক্সসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করার কথা ছিল।
প্রকল্পের আওতায় প্রথম কিস্তিতে গত এপ্রিলে প্রায় ১৪ হাজার মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর কেনার জন্য ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টের (ই-জিপি) মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রজেক্টরের উন্নতমানের স্পেসিফিকেশন ও প্রয়োজনীয় এক্সেসরিজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ ও ইনস্টলেশনের শর্ত দেওয়া হয় দরপত্রে। এই শর্ত মানতে চায়নি স্মার্ট টেকলোজিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
এরপর প্রকল্পকে ঘিরে একটি চক্র স্মার্ট টেকনোলজি লিমিটেডকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালায়। এর অংশ হিসেবে দরপত্রের শর্ত শিথিল করার প্রস্তাব দেওয়া হয় পিডিকে। কিন্তু প্রজেক্টরের উন্নতমানের স্পেসিফিকেশন এবং প্রয়োজনীয় এক্সেসরিজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ ও ইনস্টলেশনের শর্ত শিথিল করতে রাজি হননি পিডি।
এই পরিস্থিতিতে পিডির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যামিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ করে স্মার্ট টেকনোলজি লিমিটেড । যদিও তখন পর্যন্ত প্রকল্পের কেনাকাটা শুরুই হয়নি। অভিযোগের কোনও তদন্ত না করেই গত ৭ জুন প্রকল্প কর্মকর্তাকে এসডি করা হয়। পরে গত ১০ জুন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব (নিরীক্ষা) আহমদ শামীম আল রাজীকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তা গত ১৯ জুন ১৩টি পর্যবেক্ষণসহ প্রতিবেদন জমা দেন। ওই প্রতিবেদনে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। তবে অতি উৎসাহী হয়ে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে মাউশি।
অন্যদিকে, প্রকল্প পরিচালক না থাকায় ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বরাদ্দ ১৪৬ কোটি ৪২ লাখ টাকার প্রায় পুরোটাই ফেরত যায়। এতে পুরো প্রকল্পে স্থবিরতা শুরু হয়। দুই মাস ধরে প্রকল্পটি স্থবির হয়ে রয়েছে। প্রকল্পের ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অলস সময় পার করছেন।
এ অবস্থা নিরসনে গত ২৪ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকের সুপারিশ অনুযায়ী প্রকল্পের কেনাকাটা ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) পদ্ধতির পরিবর্তে ডিপিএম (ডিরেক্ট প্রকিউরম্যান্ট মেথড) পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বৈঠকে। সিদ্ধান্তের আলোকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘টেসিস’ থেকে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর,কম্পিউটারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়।
প্রকল্পে সিন্ডিকেটের বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্প ভালভাবেই চলছিল। কিন্তু একটি চক্র সুযোগ নিতে নানা তৎপরতা শুরু করে। ভিত্তিহীন অভিযোগও করতে থাকে। এখন সরকারের অগ্রাধিকারে থাকা এ প্রকল্পকে বাঁচাতে সরকারি সংস্থা টেসিসের মাধ্যমে সরঞ্জাম কেনার আলোচনা হয়েছে। প্রকল্প থেকে যারা অনৈতিকভাবে সুযোগ নিতে পারেনি তারাই প্রকল্প বন্ধের চক্রান্ত করেছে।’
প্রকল্পে দুর্নীতি ও মাউশির সুপারিশ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে আর্থিক দুর্নীতির কোনও প্রমাণ হয়নি। কিন্তু কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে মাউশি সুপারিশ করেছে তা আমার বোধগম্য নয়। প্রকল্প নিয়ে যে চক্রান্ত হয়েছে,আমার বিরুদ্ধে যে অবিচার হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয়ের কাছে লিখিতভাবে বিচার চেয়েছি।’
প্রকল্প কর্মকর্তাকে দরপত্রের শর্ত শিথিল করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলে কি-না জানতে চাইলে স্মার্ট টেকনোলজির আবুল বাশার মোহাম্মদ বলেন, ‘আমিসহ আরও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে শর্ত শিথিলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো। পিডি এমনভাবে শর্ত দিয়েছেন যে, আমরা যেন অংশ নিতে না পারি।’ সরকারের প্রকল্পটি বাতিল হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন আবুল বাশার মোহাম্মদ। যদিও প্রকল্পটি বাতিল হয়নি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের তিন হাজার ৩৪০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪৬ হাজার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং আড়াই হাজার স্মার্ট ক্লাসরুম স্থাপনসহ পাঁচ লাখেরও বেশি শিক্ষক-কর্মকর্তাকে আইসিটি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স, মডেম ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে।
লুটপাটে ব্যর্থ হয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের প্রকল্প বন্ধে সক্রিয় ‘সিন্ডিকেট’
পূর্ববর্তী পোস্ট