শিক্ষা ও রাজনীতি সংবাদ: আগামী মার্চের শেষ সপ্তাহে ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছে একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ। সেই অনুযায়ী আগামী মাসের মধ্যে প্রথম খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।
মোট তিন দফায় প্রকাশিতব্য এই তালিকা ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। আর জানুয়ারি মাসে তফসিল ঘোষণা ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ এবং পরের মাসে ব্যালট পেপার ছাপানো হবে। এক্ষেত্রে যৌথভাবে কাজ করছে প্রভোস্ট কমিটি এবং শৃঙ্খলা কমিটি।
রোববার এসব তথ্য জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সূর্যসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল।
একইদিন ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর ফোরাম পরিবেশ পরিষদের ওই বৈঠক রোববার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শুরু হয়। চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। প্রায় ১৬ বছর পর একই প্লাটফর্মে বসতে পেরে ছাত্রনেতারা ছিলেন অনেকটাই আপ্লুত। তারা মন খুলে কথা বলেছেন।
বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদলের সভাপতি কোলাকুলি করেন। বৈঠকে ছাত্রনেতারা দ্রুত নির্বাচন আয়োজনে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিতের দাবি জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল মতিন ভার্চুয়াল শ্রেণীকক্ষে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক শেষে ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। অত্যন্ত দায়িত্বশীলভাবে ও আন্তরিক পরিবেশে তারা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ২৮ বছর ধরে ডাকসু অচল আছে। এটাকে সচল করতে একটু সময়ের প্রয়োজন। এটা জোড়াতালির বিষয় নয়। আমরা সেই যৌক্তিক সময় নিয়েই নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি করেছি। এ বিষয়ে হলের প্রভোস্টরা কাজ করছেন।
জানতে চাইলে সূর্যসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ২৮ বছর ধরে যে অচলায়তন তা ভাঙতে একটু সময় লাগছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধান দুটি চ্যালেঞ্জ আছে। একটি হচ্ছে ভোটার তালিকা তৈরি, অপরটি সহাবস্থান। ৫ মাস ধরে আমরা ভোটার তালিকা তৈরির কাজ করছি। অক্টোবরের মধ্যে এ কাজ শেষ হয়ে যাবে। এখন রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সহাবস্থানও নিশ্চিত হবে। তখন আর ডাকসু নির্বাচনে কোনো বাধা থাকবে না।
বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। এ সময় প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ, প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সামাদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রাব্বানী, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন হলের প্রভোস্টরা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিএসএল), সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ ১৩টি ছাত্র সংগঠনের নেতারা বৈঠকে যোগ দেন। প্রত্যেক সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
জানা গেছে, পরিবেশ পরিষদের বৈঠকে ছাত্রনেতারা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আলাদা মতামত দিয়েছেন। কয়েকটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছে। তবে বেশির ভাগ সংগঠন জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মতামত দিয়েছে।
ছাত্রনেতাদের আলোচনায় উঠে এসেছে আরও বেশকিছু মতামত। অধিকাংশ ছাত্রনেতা ডাকসু নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সহাবস্থান নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার সমুন্নত রাখতে ডাকসু নির্বাচন জরুরি। আমরা ডাকসু নির্বাচন চাই। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের বৈধ ভোটার তালিকা করার পর নির্বাচন আয়োজনের জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি। সহাবস্থানের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি হলে যত ছাত্র বা ছাত্রী থাকেন তার মধ্যে মাত্র ৩০ ভাগ ছাত্রলীগের কর্মী বা সমর্থক। বাকিরা বিভিন্ন ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তো আছেনই। সুতরাং সহাবস্থান অটুট আছে। আমরা সবাইকে বলছি, আপনারা যারা নিয়মিত ছাত্র আছেন তারা আসুন। আমরা চাই ছাত্রদলের কেউ ক্যাম্পাসে এসে পেট্রল বোমা রাখবে না। সহাবস্থানের জন্য আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
বৈঠক শেষে ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসান বলেন, ডাকসু নির্বাচনের জন্য সর্বাগ্রে দরকার পরিবেশ। সে পরিবেশের জন্য ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে রাজনীতি করার যে স্বাভাবিক পরিবেশ, তা তৈরি করে দিতে হবে। সব সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। হলগুলোয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের থাকার উপযোগী করতে হবে। মেধার ভিত্তিতে সিট বণ্টন করতে হবে। অন্য ছাত্র সংগঠন যারা আছে তারা যেন ভীতিহীন ও নিরাপদে থাকার পরিবেশ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের একাংশের সভাপতি ইমরান হাবিব রুমন বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু নির্বাচন চেয়ে আসছি। নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে ভালো হয়। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, ‘আমরা দ্রুত ডাকসু নির্বাচন চাই। সেটা জাতীয় নির্বাচনের আগে হোক বা পরে, আপত্তি নেই। তবে এর জন্য প্রশাসনের আন্তরিকতা ও ক্যাম্পাসের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি।
ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, আমরা ডাকসু নির্বাচনের জন্য যা যা প্রস্তুতি দরকার তা সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছি। আগামী মার্চের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় সময় বেঁধে দিয়েছে। সেই সময়ের মধ্যে হোক এটা আমরা চাই।
ভিসির ব্রিফিং : বৈঠক শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, সামনে আমাদের অনেক বড় একটি বিষয় আছে। সেটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমাদের আজকের (রোববার) সভাটি ডাকা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় রীতিনীতি এবং মূল্যবোধ নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা আলোচনা করেছে। তারা যে বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছে, সেগুলো আমাদের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা নোট করেছেন। সেগুলো আলোচনা-পর্যালোচনা করে প্রতিটি বিষয় কিভাবে সমাধান করা যায়, সেগুলোর দিকে আমরা এগোব।
তিনি বলেন, সবাইকে এক করে যেন নির্বাচন করতে পারি, এমন পরামর্শ এসেছে। কেউ বলছে মার্চের মধ্যে করা যায় কি না। কেউ জাতীয় নির্বাচনের পর আয়োজনের কথা বলছেন। তবে সবাই একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন ডাকসু নির্বাচনটা করে।
কবে নাগাদ নির্বাচন দেয়া হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাবি ভিসি বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে একটা নির্দেশনা আমাদের আগেই দেয়া আছে। নির্বাচনী কাজের পরিধি নিয়ে আমাদের প্রভোস্ট কমিটি ও শৃঙ্খলা কমিটি এরই মধ্যে একটা নির্দেশনা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে ২০১৯ সালের মার্চ মাস আমাদের টার্গেটে আছে। সেখান থেকে আমাদের সরে যেতে বলেনি শৃঙ্খলা কমিটি ও প্রভোস্ট কমিটি। এ লক্ষ্যে আমরা আছি। এই নিরিখে আমাদের প্রোভোস্টরা ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য কাজ করছেন।
তিনি বলেন, অক্টোবরের মধ্যে খসড়া ভোটার তালিকা প্রণয়ন করব। এটা কঠিন কাজ। এটা করতে পারলে আমরা অনেক এগিয়ে যাব। সহাবস্থানের জন্য যা যা করা দরকার, প্রোভোস্টরা তা-ই করবেন। এগুলো নতুন কিছু নয়। সবাই অভিজ্ঞ, সবাই যা করা দরকার তা করবেন। হলে সহাবস্থান ও মধুর ক্যান্টিনে রাজনৈতিক চর্চা সবার জন্য উন্মুক্ত। আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা নেই। ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালনার জন্য যা উন্মুক্ত, সেগুলো কারও জন্য বাধা নেই।
ছাত্রলীগ-ছাত্রদল নেতার কোলাকুলি : বৈঠক শেষে বিদায় নেয়ার সময় প্রশাসনিক ভবনের সামনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসানকে জড়িয়ে ধরেন ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। শীর্ষ দুই নেতা পরস্পর কোলাকুলি করেন। বৈঠকে উভয় দল মন খুলে প্রায় একই ধারায় বক্তব্যের পর বাইরে শত শত ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীর সামনে এই ঘটনা সাময়িকভাবে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়।
প্রশাসনিক ভবনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র যুগান্তরকে বলেন, ক্যাম্পাসে এবং প্রায় সারা দেশের রাজনীতিতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করছে। এই বৈঠক ঘিরে একধরনের আতঙ্ক ও উদ্বেগ কাজ করছিল। বিশেষ করে ছাত্রদল নেতারা ছাত্রলীগের তরফে হামলা এমনকি গ্রেফতারের আতঙ্কে ছিলেন। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হয় কি না, তা নিয়েও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী, সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও গণমাধ্যম কর্মীদের কৌতূহল ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই নেতার কোলাকুলিতে সব শঙ্কা দূর হয়ে যায়।
এর আগে পরিবেশ পরিষদের বৈঠক শেষে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজোয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারা এক প্রকার আগলে রেখে ছাত্রদলের দুই নেতাকে প্রশাসনিক ভবনের ভেতর থেকে নিয়ে আসেন। এরপরই দুই নেতা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, ১৯৯০ সালের দিকে যখন ডাকসু সক্রিয় ছিল, তখন ছাত্রনেতাদের মধ্যে এমন সদ্ভাব ছিল। ক্যাম্পাসে গোলাগুলি বা মারামারির পর মধুর কেন্টিনে বা নিজ নিজ হলে একসঙ্গে পাশাপাশি অবস্থান ও খাবার গ্রহণ করতেন তারা। সেই সহাবস্থান অনেকটাই তিরোহিত ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এটি জাতীয় দৈনিকের সাবেক এক বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভের পর দুটি বাদে আর সব আবাসিক হল স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু পরে ছাত্রলীগ নেতাদের স্বাগত জানিয়েছিল ছাত্রদল। ডাকসু ভবনের সামনে উভয় সংগঠনের শীর্ষ নেতারা কোলাকুলির পর গ্রুপ ছবি তোলেন। প্রায় ১৭ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোববার একই দৃশ্যের অবতারণা ঘটল।
উল্লেখ্য, এই বৈঠক সামনে রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাড়িতে করে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদের ক্যাম্পাসে নিয়ে এসেছিল কর্তৃপক্ষ। ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের শীর্ষ দুই নেতার কোলাকুলির পর সেই গাড়িতে উঠে বসেন ছাত্রদলের নেতারা। এরপর বিদায় নেন ক্যাম্পাস থেকে।