বিদেশের খবর: সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতম কৌশলগত মিত্র সৌদি আরবকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েলের পর মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির পক্ষে জোরালো অবস্থান সৌদি আরবের। সম্প্রতি ১১০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে সেই সম্পর্ক আরও জোরালো করে ট্রাম্প প্রশাসন। সৌদি আরবের ওপর নির্ভর করেই মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনবিরোধী ‘শতাব্দীর চুক্তি’ বাস্তবায়নের আশাও করছেন তিনি। তবে খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর সেই ঘনিষ্ঠ মিত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ট্রাম্পের ওপর চাপ বাড়ছে। প্রধান মিত্রদেশগুলোর পাশাপাশি দেশের আইনপ্রণেতারাও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তাই খাশোগি ইস্যুতে প্রথম থেকেই সৌদি আরবকে সমর্থন করে গেলেও চাপের মুখে এখন প্রকাশ্যে আর সমর্থন জানাতে পারছেন না ট্রাম্প। অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে সৌদি আরবের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তাই সৌদি আরবকে নিয়ে রীতিমত বিপাকে পড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
খাশোগি নিখোঁজ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকারোক্তি দেয় সৌদি আরব। সৌদি পাবলিক প্রসিকিউটর শনিবার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে দাবি করেন, ‘স্বেচ্ছায় নির্বাসনে থাকা খাশোগিকে সৌদি আরবে ফিরিয়ে আনার জন্য সাধারণ নির্দেশনা জারি ছিল। যখন খবর আসে বিয়ের জন্য কিছু নথিপত্র নিতে ২ অক্টোবর খাশোগি ইস্তানবুল কনস্যুলেটে যাবেন তখন জেনারেল আসিরি ১৫ সদস্যের একটি দল পাঠান এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনা করতে। সৌদি কনস্যুলেটে দেখা করতে যাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে খাশোগির লড়াই হয়। আর তাতেই খাশোগির মৃত্যু হয়।’ তবে সৌদি আরবের এই বয়ান মানতে রাজি নয় ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্য মিত্ররা। এছাড়া খোদ যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারাই সৌদি আরবের এই ভাষ্য প্রত্যাখ্যান করে দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি জানিয়েছেন।
খাশোগি নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় ১১ জন রিপাবলিকান ও ১১ জন ডেমোক্র্যাট সিনেটরের একটি দল ঊর্ধ্বতন সৌদি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে একটি চিঠি পাঠান। সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির একজন সদস্য বাদে বাকিরা সবাই ১০ অক্টোবর পাঠানো ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। চিঠিতে ম্যাগনটস্কি আইন অনুযায়ী খাশোগি হত্যাকাণ্ড তদন্ত ও নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ২০১৬ সালে মানবাধিকার হরণ প্রশ্নে প্রণীত এই আইন অনুযায়ী বিশ্বের যেকোন প্রান্তের দোষী সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। আইন অনুযায়ী চিঠি পাঠানোর ওই দিন (১০ অক্টোবর) পরবর্তী ১২০ দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনকে। এবার হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা প্রশ্নে স্বীকারোক্তির পর রিয়াদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সেই দাবি জোরালো করেছেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা।
সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য ও নিউ জার্সির ডেমোক্র্যাট সিনেটর রবার্ট মেনেনদেজ সৌদি বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা সত্য থেকে অনেক দূরে। আমাদের আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখা দরকার।’ তিনি বলেন, বৈশ্বিক ম্যাগনিটস্কি আইন অনুযায়ী চিঠি পাঠিয়ে প্রেসিডেন্টকে তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথ করে দিয়েছে কংগ্রেস। এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অবশ্যই এই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’ সিনেটের বৈদেশিক কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান সিনেটর বব কর্কারও চান যুক্তরাষ্ট্র খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বৈশ্বিক ম্যাগনিটস্কি আইন প্রয়োগ করে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, তারা তাদের তদন্ত চালিয়ে যেতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজস্ব স্বাধীন ও বিশ্বাস্য তদন্ত অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে। বৈশ্বিক ম্যাগনিটস্কি আইনের প্রয়োজন অনুযায়ী খাশোগির হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে এই তদন্ত প্রয়োজন।
ভার্জিনিয়ার ডেমোক্র্যাট সিনেটর গ্যারি কনোল্লি বলেন, শুরু থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে এই ঘটনা মোকাবিলা করছেন তা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটা খুব ভালো হবে না যে, আমাদের প্রেসিডেন্ট সত্যিকার অর্থে খুনিদের পক্ষ নিচ্ছে।’ কংগ্রেসের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির শীর্ষস্থানীয় সদস্য ও ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর এলিয়ট এল অ্যাঞ্জেল ‘একটি স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত’ চালানোর জন্য আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানান।
শুধু দেশের মধ্যেই নয়, দেশের বাইরে সৌদি ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর চাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ইউরোপের পক্ষ থেকেও সৌদি বয়ান প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এর পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোঘারিনি একে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির ভয়াবহ লঙ্ঘন আখ্যা দিয়েছেন। ঘটনার যথাযথ পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে এ পর্যন্ত যা জানা গেছে, তা খুবই ভয়াবহ। এটি ১৯৬৩ সালের ভিয়েনা চুক্তির লঙ্ঘন।’ এ ঘটনায় দোষীদের বিচার নিশ্চিতেরও তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস তাদের বিবৃতিতে বলেছেন, ‘খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরবরাহকৃত সৌদি ব্যাখ্যা পর্যাপ্ত নয়। এখনও কিছুই পরিষ্কার হয়নি, কী ঘটেছে তা অনুসন্ধানের জোর দাবি জানাচ্ছি’। বিবৃতিতে দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় নেওয়ারও জোর দাবি জানানো হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস জার্মানির রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম এআরডি-কে বলেছেন, ‘যতোক্ষণ পর্যন্ত বিয়ষটি তদন্তাধীন, যতোক্ষণ পর্যন্ত আমরা সবকিছু স্পষ্ট করে জানতে পারছি না, ততোক্ষণ পর্যন্ত সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে ইতিবাচক কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নাই।’
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন ইভস লে ড্রিয়ান বলেছেন, ‘অনেক প্রশ্নের উত্তরই এখনও অজানা এবং সেসব জানতে প্রয়োজন একটি পুঙ্খানুপুঙ্খু ও কার্যকর তদন্ত’। কানডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড বলেছেন, ‘যে বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে তার ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ’। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, ‘জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডে আমরা মর্মাহত। এ ঘটনার যথাযথ তদন্তে তুরস্ককে পূর্ণাঙ্গ সহায়তা দিতে আমরা সৌদি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই।’
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতম কৌশলগত মিত্র সৌদি আরব। ইসরায়েলের পর মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির পক্ষে জোরালো অবস্থানই তাদের। সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ১১০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে সেই সম্পর্ক আরও জোরালো করে ট্রাম্প প্রশাসন। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার নামে ট্রাম্প প্রশাসন ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’র মোড়কে যে ফিলিস্তিনবিরোধী পদক্ষেপ নিতে চাইছেন, তা নিয়েও সৌদি দূতিয়ালির ধারাবাহিক খবর প্রকাশিত হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। তাই খাশোগি নিখোঁজের পর থেকেই তাই ট্রাম্পের সৌদি সখ্যের প্রশ্নটি বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশয় দেখা দিয়েছে, এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে কিনা। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সৌদি আরবের সরবরাহকৃত ব্যাখ্যাকে ‘গ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে সেই সংশয় আরও বাড়িয়ে তোলেন ট্রাম্প।
তবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সৌদি আরব প্রশ্নে নিজের পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে খানিকটা সরে এসেছেন ট্রাম্প। শুক্রবার ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরবরাহকৃত সৌদি ব্যাখ্যাকে ‘গ্রহণযোগ্য’ দাবি করলেও শনিবার ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে শামিল হয়ে ট্রাম্প বলেন, ব্যাখ্যাই যথেষ্ট নয়। সত্য উন্মোচনের আগ পর্যন্ত তিনি সন্তুষ্ট নন। তবে শেষ পর্যন্তও সৌদি আরবকে রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। শনিবার সত্য উন্মোচনের দাবি জানানোর পাশাপাশি এটাও দাবি করেছেন যে, এই ঘটনার সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতা নাও থাকতে পারে। এছাড়া রিয়াদের সঙ্গে করা প্রতিরক্ষা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনাও নাকচ করেন তিনি। শনিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ নিষেধাজ্ঞা একটা পথ বটে, তবে অস্ত্র চুক্তি স্থগিত করলে তা তাদের চেয়ে আমাদের জন্য বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারে।’
খাশোগি হত্যাকাণ্ডে প্রথম দিকে কঠোর অবস্থান নিলেও সৌদি বাদশাহ ও যুবরাজের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর সুর নরম করেন ট্রাম্প। সংকট মোকাবিলা করে সৌদি আরবকে সুরক্ষা দিতে তাৎক্ষণিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে সৌদি আরব ও তুরস্ক পাঠান তিনি। তবে খাশোগির ঘটনার তদন্তে অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেই অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য হন ট্রাম্প। নানামুখী চাপের কারণে সৌদি আরবকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে পারছেন তিনি। আবার সৌদি আরব বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়লে তার মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এই সময়ে এসে সৌদি আরকে নিয়ে বেশ বিপাকেই পড়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।