বিভুরঞ্জন সরকার: জেলা শহরগুলো এখন নেতাশূন্য। কথা বলার জন্য তেমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সারা দেশের মূল মূল রাজনৈতিক নেতারা ঢাকায়। সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য লবিং-তদ্বির করতে বিভিন্ন দলের নেতারা সঙ্গী-সাথি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ২৩০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর ২৫ নভেম্বর বিকেলে খুলনায় দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করে পেলাম না।
তবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কিছু প্রতিক্রিয়া জানা গেলো। খুলনা জেলায় মোট ছয়টি আসন। তার মধ্যে সদরে দুটি আসন। মুসলিম লীগের জাঁদরেল নেতা সবুর খানের বাড়ি হওয়ায় এখানে স্বাভাবিকভাবেই তার সমর্থকগোষ্ঠী ছিলো। সাবেক মুসলিম লীগাররা পরে বিএনপি হওয়ায় খুলনা শহরে বিএনপির প্রভাব বেশি। খুলনা সদরে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। এবার কি হবে নির্বাচনের ফলাফল? নতুন প্রজন্মের ভোটারদের মধ্যে কি মুসলিম লীগের লিগেসি আছে?
এসব প্রশ্নের সরাসরি জবাব পাওয়া যায় না। কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে চান না।
গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়রপদে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের তালুকদার আব্দুল খালেক। তিনি আগেও মেয়র ছিলেন। জনপ্রিয় নেতা। ভালো নির্বাচন হলেও তিনি জিততেন বলে অনেকেই বললেন। তবে ব্যবধান হয়তো কম হতো। কিছুটা অনিয়ম করে তার ভোটের ব্যবধান বাড়ানোর কোনো দরকার ছিলো না। শহরে বিএনপির যে একক আধিপত্য বা প্রাধান্য ছিলো, সেটা এখন কিছুটা কমেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জেতার অবস্থা তৈরি হয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত নয়।
এবার খুলনা শহরের দুটি আসনের একটিতে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে শেখ জুয়েলকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসেরের পুত্র শেখ জুয়েল একজন ব্যবসায়ী। তিনি সক্রিয় রাজনীতি না করলেও তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তার যেমন কোনো নেতিবাচক ইমেজ নেই, তেমনি নেই কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা। বিএনপি প্রার্থীর শক্ত প্রতিপক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে শেখ জুয়েলের। আওয়ামী লীগ যদি ঐক্যবদ্ধভাবে জুয়েলের পেছনে কাজ করে তাহলে নির্বাচনের ফলাফল তার অনুকূলে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাগেরহাটের দুটি আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন শেখ পরিবারের দুই সদস্য। একজন শেখ হেলাল, শেখ নাসেরের বড় পুত্র, অন্যজন শেখ হেলালের পুত্র শেখ তন্ময়। খুলনা এবং বাগেরহাটে ‘তিন শেখের’ মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে ঠাট্টা-তামাশাও হচ্ছে। অনেকেই বিষয়টিকে বাঁকা চোখে দেখছেন। প্রশ্ন উঠছে , আওয়ামী লীগ কি পারিবারিক সংগঠনে পরিণত হচ্ছে? যোগ্যতা থাকলেও এক পরিবারের এতোজন সদস্যকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দিলে দলের ভেতরেও কথা উঠবে ।
আওয়ামী লীগ যে সেভাবে প্রার্থী বদল করলো না, তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে। বিতর্কিত মন্ত্রী-এমপিদের আবার মনোনয়ন দেওয়ার পেছনে ‘অন্য’ কারণ আছে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনে ঝুঁকি দেখা দিতে পারে ধরে নিয়েই এমন প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে যারা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম। মানুষ মনে করছে, আওয়ামী লীগ জেতার জন্য নির্বাচন করছে। জেতার জন্য যা যা করা দরকার তারা তাই তাই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ মাঠ ছেড়ে দেওয়ার পার্টি নয়। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা যাদের আছে তাদের ছাড়া আর কাউকে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে না।
আগামী নির্বাচন হবে আওয়ামী লীগের জন্য এক মারাত্মক শক্তিপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় হারজিতের ওপর দেশের রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে না এলে দেশের উন্নতির চাকা পেছনের দিকে ঘুরবে এমন আশংকা অনেকের মধ্যেই আছে। শেখ হাসিনা টানা দশ বছর দেশ শাসন করছেন। অনেক ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু তার দলের একাংশ নানা রকম অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে আওয়ামী লীগকেই বড় চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
দুই জন রানিং সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন না দিয়ে একজনের স্ত্রীকে এবং একজনের বাবাকে মনোনয়ন দেওয়াকেও আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারাকে জোরদার করার নজির হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
নেত্রকোনায় একজন এমপিকে মনোনয়ন না দিয়ে কোন যোগ্যতায় এবং কোন বিবেচনায় তার ভগ্নিপতিকে মনোনয়ন দেয়া হলো, সে প্রশ্নও উঠছে। মনোনয়নবঞ্চিত এমপি ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তেমন বিতর্ক শোনা যায় না। তারপরও তাকে বাদ দিয়ে তার বোনের বর মানু মজুমদারকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। মানু মজুমদারের বাড়ি নেত্রকোনায় নয় এবং তিনি রাজনীতিতেও ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে তুলনীয় নন। নির্বাচনে জিতে আসতে পারলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ফলাফল খারাপ হলে বিতর্কিত মনোনয়নের বিষয়গুলোই বড় হয়ে সামনে আসবে। বিষয়গুলো তৃণমূলের মানুষেরও নজর এড়াচ্ছে না।
লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়