দেশের খবর: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির ১১টি অভিযোগ তুলে ধরেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনের ছয় দিন পর রোববার ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে জোটের নেতারা এসব অভিযোগ বর্ণনা করেন। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলেন, সরকার সংলাপে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশ্বাস দিলেও তা রক্ষা করেনি। নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হয়নি। ভোট কারচুপি করায় দেশের মানুষ ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের স্বার্থে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্রুত অর্থবহ পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট।
রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত বৈঠকে লিখিত বক্তব্যে এসব অভিযোগ করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। বৈঠক সূত্র জানায়, ড. কামালের লিখিত বক্তব্যে কূটনীতিকরা জানতে চান, ঐক্যফ্রন্টের বিজয়ীরা শপথ নেবেন কি-না? জবাবে নেতারা জানান, তারা আলোচনা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। ড. কামালের লিখিত বক্তব্যের পর তিন দেশের রাষ্ট্রদূত নির্বাচন সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
বিকেল ৪টা থেকে দেড় ঘণ্টা কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডেভিড আর্ল মিলারসহ যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্টদূতসহ ৩৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও তাদের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে রাশিয়া, চীন, কোরিয়া, ফ্রান্স, সুইডেন, স্পেন, জার্মানি, নরওয়ে, ভারত, পাকিস্তান, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকার প্রতিনিধিও অংশ নেন।
কূটনীতিকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন জানান, তাদের সঙ্গে ভালো আলোচনা হয়েছে। ভোটের দিন যা ঘটেছে, তা তারা তুলে ধরেছেন। কূটনীতিকরা তাদের কথা শুনেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা সরকারকে বোঝাও, এর সমাধান করতে হলে আরেকটা ভালো নির্বাচন দিতে হবে।
ড. কামাল হোসেন বলেন, তারা জানতে চেয়েছেন নির্বাচনের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত কী? উত্তরে আমরা বলেছি- এই নির্বাচন হয়নি। আরেকটা ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সবাই ভোট দিতে পারলে শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে। আমরা সবাই মিলে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ব। সরকারকে বলছি, দেশে শান্তিপূর্ণভাবে আরেকটা নির্বাচন হলে তার ফলাফল যা হয়, তার ভিত্তিতে একটা গণতান্ত্রিক সরকার হবে। সে সরকারই মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে।
বৈঠকে ড. কামাল হোসেন একাদশ নির্বাচনের ভোট পরিস্থিতি ও নির্বাচনের আগে-পরের ঘটনাবলি তুলে ধরে তিন পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সারাদেশে নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ে কথা বলেন।
বৈঠকে নির্বাচনে ভোটের নানা অনিয়মের ১০টির বেশি ভিডিও প্রদর্শন করেন নেতারা। এসব ভিডিওসহ তথ্য-প্রমাণাদি সম্পৃক্ত কাগজপত্র কূটনীতিকদের সরবরাহ করা হয়।
বৈঠকে নির্বাচনের প্রচারাভিযানে ক্ষমতাসীন দল ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিভিন্ন স্থানে হামলার শিকার ধানের শীষের প্রার্থী গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আফরোজা আব্বাস, রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা, জেবা খানও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, ড. কামাল হোসেনের লিখিত বক্তব্যে মোট ১১টি বিষয় অভিযোগ আকারে তুলে ধরা হয়। বক্তব্যের শুরুতেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ক্ষমতাসীন দলের ‘জালিয়াতির ভোট উৎসব’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, এ নির্বাচনটি হয়েছে রাষ্ট্র বনাম জাতির মধ্যে। যেখানে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে একটি জাতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে জনমতকে ছিনতাই করা হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই সরকার এ কার্যক্রমের প্রক্রিয়াকে আরও পাকাপোক্ত করেছে।
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে কলুষিত করার জন্য শুরু থেকেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। গায়েবি ও মিথ্যা মামলায় নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হয়।
লিখিত বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা, তার জামিন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের ঘটনাকেও ‘সরকারের পূর্বপরিকল্পিত’ বলে অভিযোগ করেন ড. কামাল। তার মতে, বিচার বিভাগের মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে।
ড. কামাল হোসেন তার উত্থাপিত ১১টি অভিযোগের প্রথমটিতে বলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে প্রতিদিনই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তারা বাছাইকৃত সাংগঠনিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে এবং তাদের পরিবারকে হুমকি দিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশল নেয়। সরকারি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের মধ্যে ১৪১ জনের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন (ইসি) দ্বৈত নীতি অবলম্বন করে। এর মধ্যে ১৮ জনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করার পর বাতিল করা হয়। প্রার্থিতা বাতিলের মিশন শুরু করে নির্বাচনী প্রচার থেকে কৌশলে দূরে থেকে তাদের প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার জন্য সময় ব্যয় করতে হয়। নির্বাচনের আগে তাদের ১৬ প্রার্থীকে কারাগারে নেওয়া হয়। ৫১ প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে শারীরিকভাবে আহত করা হয়। এসব প্রার্থীসহ বিরোধী দলের সব প্রার্থী তাদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ইসিতে আবেদন করেও কোনো সমাধান পাননি। নির্বাচনের আগে তাদের পোলিং এজেন্টদের টার্গেট করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার অভিযান শুরু করে। নির্বাচনের দিন তাদের বাকি এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়, মারধর করা হয়।
ড. কামাল হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগের রাতে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোটবাপ পূর্ণ করা হয়। নির্বাচনের দিনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাকি ভোটও জালিয়াতি করে। যার কারণে কোনো কোনো আসনে মোট ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট পড়ে। নির্বাচনের দিন ভোটাররা ভোট দেওয়ার আগেই ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায়। ভোটাররা ভোট দেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করলেও ভোট দিতে পারেননি। বিশেষ করে নারীদের ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। অন্যদিকে কেন্দ্রের মূল ফটকে তালা দিয়ে ভেতরে সরকারদলীয় নেতাকর্মী জাল ভোট দিয়ে ব্যালট বাপ ভরে ফেলে। নির্বাচনকে বিঘ্নিত করতে সারাদেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। গণপরিবহন থেকে শুরু করে সব যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিএনপির নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে দেশের ৫৪টি পোর্টাল বন্ধ করে নির্বাচনকে তাদের মতো করে সাজানো হয়।
তিনি বলেন, নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হলেও তাদের কার্যকর কোনো ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি। যে কারণে জনগণের প্রত্যাশা থাকলেও তারা নির্বাচনের দিন কোনো অনিয়মের প্রতিকার করতে সক্ষম হয়নি।
এ সময় ড. কামাল তারা লিখিত বক্তব্যে নির্বাচন-পরবর্তী করণীয় নিয়ে ছয়টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে জনগণের ভোটাধিকার ও প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার রক্ষায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া; নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে- এই প্রক্রিয়াকে সঠিক পথে ফেরানোর চেষ্টা করা; স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন ফিরিয়ে আনা, সংবিধানে দেওয়া সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জোর দেওয়া।
বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান রিপন, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, ফাহিমা নাসরিন মুন্নী, তাবিথ আউয়াল, গোলাম মওলা রনি, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, মোস্তফা মহসিন মন্টু, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না ও গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।