নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার ইছামতি টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজে এক তদন্তকার্য সম্পন্ন হয়েছে। তদন্তে কেঁচো খুড়তে সাপ বের হয়েছে। সোমবার খুলনা আঞ্চলিক পরিচালক প্রকৌশলী অনিমেষ পালের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি কলেজে আসলে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।
সূত্রে জানা যায়, গত ২৭অক্টোবর২০১৯ তারিখে অত্র কলেজের প্যাডে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শ্যামল কুমার সরকার ও সভাপতি মোঃ আখতারুজ্জামানের স্বাক্ষরে শুন্য পদে অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ বাছাই কমিটিতে ডিজি প্রতিনিধি চেয়ে পত্র প্রেরন করলে উক্ত কলেজের অধ্যক্ষ পদ শুন্য কিনা এবং প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শেখ মনিরুজ্জামানের নিয়োগ ও শিক্ষাগত যোগ্যতা সঠিক কিনা এ বিষয়েসরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য ০৫নভেম্বর ২০১৯ তারিখে আঞ্চলিক পরিচালক, খুলনা অঞ্চল, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরকে পত্র প্রেরণ করেন। সে মোতাবেক আঞ্চলিক পরিচালক প্রকৌশলী অনিমেষ পাল, পরিদর্শক শেখ মুস্তাফিজুর রহমানসহ ৩সদস্যের এক তদন্ত দল ১৮নভেম্বর২০১৯ সোমবার সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার ইছামতি টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজে সরেজমিনে তদন্তকার্য সম্পন্ন করেন।
তদন্তে জানা যায়, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শেখ মনিরুজ্জামান বিধি মোতাবেক ৩০/০৬/২০০৬খ্রিঃ তারিখে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০১০সালের মে মাসে কলেজটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর কলেজের সভাপতি মোঃ আখতারুজ্জামানজাল-জালিয়াতিপূর্বক এই কলেজের জমি, অবকাঠামো দেখিয়ে ইছামতি কৃষি প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট নামে কৃষি ডিপ্লোমা শিক্ষাক্রমের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের অনুমতি নেন। এইচএসসি (বিএম) এর জন্য মাত্র দু’টো ক্লাসরুম আছে। এসএসসি (ভোকেশনাল) ও কৃষি ডিপ্লোমার শিক্ষার্থীদের কোন ক্লাসরুম নেই। দু’টো প্রতিষ্ঠানের নামে ২লক্ষ ও ৫লক্ষ টাকার এফডিআর নেই। ক্লাসরুম ও এফডিআর করার ব্যাপারে সভাপতির সাথে অধ্যক্ষের মনোমালিন্যের সূত্র ধরেই ২০১১সালের অক্টোবরে অধ্যক্ষ শেখ মনিরুজ্জামান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হলে সে সুযোগে স্বেচ্ছাচারীভাবেতাকে চাকুরি হতে অপসারন ও বাধ্যতামূলক ছুটিতে যাইবার নির্দেশ প্রদান করা হয় এবং বিধি পরিপন্থীভাবে একই পত্রে অত্র কলেজের সিনিয়র শিক্ষককে দায়িত্ব না দিয়ে তৎকালিন ননএমপিও শ্যামনগর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ হাফিজুল আলমাহমুদকে অত্র কলেজের অধ্যক্ষের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। সভাপতি কর্তৃক অবৈধ অপসারণ আদেশ প্রত্যাহার করে স্বপদে বহালের জন্য বিধি মোতাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড বরাবর আপীল আবেদন করলেও বোর্ড কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় অধ্যক্ষ শেখ মনিরুজ্জামান অপসারন আদেশের বিরুদ্ধে দেবহাটা সহকারী জজ আদালত, সাতক্ষীরাতে ৪৪/১২নং মামলা দায়ের করেন। মামলা চলাকালীন সভাপতি মোঃ আখতারুজ্জামান ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ হাফিজুল আলমাহমুদ যোগসাজশ করে জাল স্বাক্ষরে টেবুলেশনশীট, রেজুলেশন তৈরি করে; মামলা নেই মর্মে প্রত্যয়ন ও শেখ মনিরুজ্জামানের তারিখবিহীন একটি জাল পদত্যাগপত্র তৈরি করে তা দিয়ে মোঃ নুরুল ইসলাম নামক একজনকে নিয়োগ দেখিয়ে এমপিও’র আবেদন করেন। মামলায় ১নং বিবাদী সভাপতি কোথাও পদত্যাগের কথা বলেননি। ২০১৪সালে দেবহাটা সহকারী জজ আদালত, সাতক্ষীরার ৪৪/১২নং মামলার আদেশ হয়, যেখানে অত্র কলেজের অধ্যক্ষ পদ শূন্য ঘোষনা করা যাবে না এবং শেখ মনিরুজ্জামানের স্থলে অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না মর্মে উল্লেখ আছে। বর্তমানে মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন এবং উচ্চ আদালতের আদেশেও দেবহাটা সহকারী জজ আদালতের ৪৪/১২নং মামলার আদেশ বহাল করা হয়েছে চুড়ান্ত শুনানী না হওয়া পর্যন্ত।
মোঃ নুরুল ইসলামের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রলালয়ের নির্দেশনা ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক গঠিত তৎকালিন যশোর পলিটেকনিকের প্রিন্সিপাল প্রকৌশলী মোঃ সামসুল আলম, সাতক্ষীরা পলিটেকনিকের চিফ ইনস্ট্রাক্টর ড: এম এম নজমুল হক ও আবু আহমেদ সমন্বয়ে ৩সদস্যের তদন্ত কমিটির তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রলালয় জাল-জালিয়াতিপূর্বক নিযোগকৃত অধ্যক্ষ মোঃ নুরুল ইসলামের এমপিও স্থায়ীভাবে বাতিল ও এ যাবত উত্তোলিত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরতের জন্য পিডিআর অ্যাক্ট ১৯১৩ এ মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন। সেমতে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর সাতক্ষীরা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও সাতক্ষীরা জজ আদালতের বিজ্ঞ সরকারী কৌশলীকে পিডিআর অ্যাক্ট ১৯১৩ এ মামলা দায়েরের ক্ষমতা অর্পণ করেন। গত ৩১/০১/২০১৮খ্রিঃ তারিখে মোঃ নুরুল ইসলামের পদত্যাগের প্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এমপিওশীট থেকে তার নাম কর্তন করে। পরবর্তীতে ০৯/০৯/২০১৮খ্রি: তারিখে অত্র কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির ৭৫নং জরুরী সভায়হাইকোর্টের সিভিল রিভিশন ২৩৬৪/২০১৪ এর নির্দেশনার আলোকে শেখ মনিরুজ্জামানের পুর্নবহালসহ এমপিও বহাল ও বেতন ছাড়করনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং রেজুলেশন করা হয়। সেমতে ১৬/০৯/২০১৮খ্রি: তারিখে ২২০/১৮স্মারকে ও ০৩/০৬/২০১৯খ্রি: তারিখে২২৪/১৯স্মারকে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর শেখ মনিরুজ্জামানের বেতন ছাড়ের জন্য সভাপতি প্রতিস্বাক্ষরিত আবেদন করা হয়। তদন্তে সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে যে ইছামতি টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ পদ শুন্য নয় এবং শেখ মনিরুজ্জামান অত্র কলেজের বৈধ অধ্যক্ষ। সভাপতি মোঃ আখতারুজ্জামান বিধি বর্হিভুতভাবে, স্বেচ্ছাচারী হয়ে আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েজাল-জালিয়াতিপূর্বক আবার নিয়োগ বোর্ড গঠন করে নিয়োগ বাণিজ্য করার অশুভ পায়তারা চালিয়েছেন যা কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সতর্কতার জন্য বন্ধ হল। তদন্তে আরো উদঘাটিত হল যে, অত্র কলেজের নামে এফডিআর নেই। এই কলেজের জমি, অবকাঠামো দেখিয়ে ইছামতি কৃষি প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট নামে কৃষি ডিপ্লোমা শিক্ষাক্রমের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। আর সভাপতি মোঃ আখতারুজ্জামান পরিচালিত ১৭টি প্রতিষ্ঠানেরই এফডিআর নেই। প্রতিষ্ঠানের নামে জমি নেই এবং বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ভাড়াবড়িতে পরিচালিত।
তদন্ত কাজে সহযোগিতার জন্য তদন্ত কমিটি সভাপতি মোঃ আখতারুজ্জামানকে ইছামতি টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজে উপস্থিত থাকার অনুরোধ করলেও তিনি উপস্থিত না থাকায় ফিরতি পথে সাতক্ষীরা শহরের আমতলা মোড়ে তার বাড়িতে দেখা করতে গেলেও তিনি সামনে আসেননি; আত্মগোপনে ছিলেন। উল্লেখ্য, তার বাড়ির পিছনের দু’টো টিনশেডে নীতিমালা বর্হিভূতভাবে বাণিজ্যিকভাবেজমি ও এফডিআরবিহীন, এমপিওভুক্ত এভিএএস টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজ, এভিএএস মেডিকেল সায়েন্স ইনস্টিটিউট, এভিএএস পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং এভিএএস কৃষি ও মৎস্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট নামের ৪টি কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। ৪টি কলেজেরই অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার স্ত্রী সেলিনা সুলতানা।
পূর্ববর্তী পোস্ট