তরিকুল ইসলাম লাভলু : কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত-প্রখ্যাত এই খনার বচনটি মানুষের অন্তরে গেঁথে আছে বহু কাল ধরে। বচনটি পরিবর্তন না হলেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে তাঁতে। উৎপাদনেও এসেছে পরিবর্তন। তাই তাঁতেই কাপড়, তাঁতেই ভাতের স্থলে এখন তাঁতেই গজ-ব্যান্ডেজ,তাঁতেই ভাত বললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা ইউনিয়নের পশ্চিম নলতা, মাঘুরালী, মধ্য নলতা, পূর্ব নলতা, ইন্দ্রনগর ও সোনাটিকারী গ্রামের নারী-পুরুষ এখন ব্যস্ত গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি কাজে। তাতে উৎপাদিত হচ্ছে উন্নতমানের সার্জিক্যাল গজ-ব্যান্ডেজ। এ কাজ করে উপজেলার প্রায় আট হাজার পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। আর এসব উৎপাদিত গজ-ব্যান্ডেজ যাচ্ছে ঢাকা, খুলনা, চট্রগ্রামসহ সারাদেশে।
নলতা ইউনিয়নের নলতা শরীফ এলাকায় ঢুকতেই কানে শব্দ আসে খট খট খট…। এক বাড়ি নয়, দুই বাড়ি নয়,পাশাপাশি প্রায় সব বাড়িতেই একই শব্দ। প্রতিটি বাড়িতে চলছে আধুনিক বিদ্যুৎচালিত তাঁত পাওয়ার লুম। পাশাপাশি দুই/তিনটা পাওয়ার লুম পরিচালনা করছেন একেকজন আবার কেউ বা বাঁধছেন সুতা।
২০ বছর আগেও এখানকার কারিগররা হস্ত পরিচালিত তাতে বুনতেন শাড়ি,গামছা ও লুঙ্গি। কিন্তু এখন সবাই বোনেন গজ-ব্যান্ডেজ। আর এর উপরেই নির্ভর করে তাদের জীবন-জীবিকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,দীর্ঘ ২৫/২৬ বছর ধরে নিজের বাড়িতেই আপন মনে তাঁত বুনছেন মিজান কারিগর। পারিবারিকভাবে তাঁতের সঙ্গেই তার পরিচয়।বাপ-দাদা সবাই তাঁত বুনতেন। তখন শাড়ি, গামছা, লুঙ্গি তৈরি হতো। তখন পুরো জেলায় নলতার গামছার নাম ছিল। আমিও কাজ শিখে প্রায় প্রায় ১২ বছর শাড়ি,লুঙ্গি আর গামছা তৈরি করেছি। কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। এলাকার সবাই চলে আসি গজ-ব্যান্ডেজে।
শাড়ি, লুঙ্গি বা গামছা তৈরি ছাড়ার কারণ হিসাবে ফয়সাল কারিগর বলেন, এখন আর সেই সুতা, রং আসেনা। রং করলে স্থায়ী হয়না। তাই সবাই গজ-ব্যান্ডেজ তৈরির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এখন মহাজনেরা নারায়নগঞ্জ থেকে সুতা এনে আমাদের কাছে দেয়। আমরা সেই সুতা দিয়ে শুধু গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি করি এবং সে অনুযায়ী মজুরি পায়।
মধ্য নলতা গ্রামের তাঁতি রফিকুল ইসলাম বলেন, সুতা মহাজন দেয় আর আমরা শুধু কাজ কারি। মেশিন আমদের। ৩৬ হাত গজ-ব্যান্ডেজে এক একটি রোল তৈরি হয়। এক রোল তৈরি করলে ২০ টাকা পায়।একা তিনটা মেশিন চালানো যায়। প্রতিটি মেশিনে দিনে ছয়/সাতটি রোল গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি করা যায়।
তাঁতি শুশিল দাস বলেন, এখন তো আর হাতের তাঁত নেই। এক একটা পাওয়ার লুম মেশিনের ২৪ থেকে ২৬ হাজার টাকা দাম পড়ে। নিজস্ব তিনটা মেশিনে আমি প্রতিদিন কাজ করে গড়ে আমি চারশ টাকা পাই।
তিনি আরোও বলেন, আগে আয় বেশি হতো আর এখন ৩৬ হাত লম্বা গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি করে মাত্র ২০ টাকা পায়। কিন্তু তাতে উৎপাদিত শাড়ির দাম বেশি ছিলে। যদিও উৎপাদন বেশি,কস্ট কম। মেশিন অন করে চালিয়ে রেখে মাঝে মধ্যে একটু দেখাশোনা করলেই হয়।
মাঘুরালী গ্রামের তাঁতি লতিফার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি মেশিনে সুতা বাধছিলেন। সুতা বাধার জন্য তিনি পান একশ টাকা। এই কাজে কষ্ট কম বলে লতিফার মতো কয়েকশ গৃহিণী নারীসহ পরিবারের সবাই মিলে পাওয়ার লুম মেশিনে গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি করে।
ইয়াসিন নামে অপর এক তাঁতি বলেন, এলাকার বেকার ছেলে-মেয়েরা ডিজিটাল এই পাওয়ার লুম মেশিনে কাজ করে এবং এতে আয়ও বেশ ভাল হয়। তবে এই আধুনিক পাওয়ার লুম মেশিনে যে কোনো সমস্যা নেই তা কিন্তু নয়! একদিন বিদ্যুৎ না থাকলে বন্ধ হয়ে যায় নলতা এলাকার গজ-ব্যান্ডেজ তৈরির কর্মযজ্ঞ। আর রয়েছে মধ্যসত্ত্বভোগীদের থাবাও।
তাঁতশিল্পের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহকারী নলতার ওমর আলী, মাসুল, ফারুক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, গোপাল, দীপঙ্কার ও নাসিমা খাতুন বলেন, গজ-ব্যান্ডেজ তৈরির কাজে আসার পর থেকে এখন আর তাদের সংসারে অভাব নেই।
এলাকায় তাঁত ব্যাবসার মহাজন বলে পরিচিত শ্যামল চন্দ্র পাল বলেন,তার কারখানায় ২৫টি পাওয়ার লুম মেশিন রয়েছে। এখানে আট/নয়জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে। নারায়নগঞ্জ থেকে সুতা এনে প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই সরবারহ করেন তিনি। একই সাথে তার কারখানায়ও গজ-ব্যান্ডেজের কাজ চলে।
তিনি আরও বলেন, সুতা এনে গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি করতে প্রত্যেক পিসে (রাল) ২০ টাকা দিতে হয়। তারপার ব্যান্ডেজগুলো ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে পাঠানো হয় ঢাকা, খুলনা, চট্রগ্রামসহ সারাদেশে। আমরা সুতার দাম দুই/তিন টাকা লাভে বিক্রয় করি। সরকার যদি সরাসরি আমাদের কাছ থেকে পণ্য নিতো তাহলে আমরাও বাঁচবো আর ক্ষুদ্র কারিগররাও বেশি মজুরি পাবে। বড় বড় কোম্পানীগুলো আমাদের কাছ থেকে গজ-ব্যান্ডেজ নিয়ে সরকারের কাছে সরবারহ করে সে কারণে আমরা অধিক লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
পূর্ববর্তী পোস্ট