দেশের খবর: কয়েক মাস আগে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ নেতা দুই ভাই এনামুল হক এনু ও রূপন ভূঁইয়ার বিপুল অবৈধ অর্থ-সম্পদের সন্ধান পাওয়ার পর তাঁরা জাল পাসপোর্ট তৈরি করে মিয়ানমারে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল না হয়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কাছে একটি ভবনে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন এবং পরে ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর নেপালে যাওয়ার চেষ্টা চালান। তাতেও ব্যর্থ হন। কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা প্রভাবশালীদের দ্বারে ধরনা দিয়েছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গতকাল সোমবার সকালে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গ্রেপ্তারের পর দুই ভাইয়ের কাছ থেকে ৪৪ লাখ টাকা ও ১২টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের জমিসহ ২২টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট, ৯১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং এসব অ্যাকাউন্টে ১৯ কোটি টাকা থাকার তথ্য পেয়েছে সিআইডি। সিআইডি সূত্র জানায়, গত সাত বছরে এই দুই ভাই বাড়ি কিনেছেন ১২টি। ফ্ল্যাট কিনেছেন ছয়টি। পুরনো বাড়িসহ নতুন নতুন কেনা জমিতে গড়ে তুলেছেন ইমারত। দুই ভাইয়ের মূল পেশা ছিল জুয়া আর নেশা ছিল বাড়ি কেনা। জুয়ার টাকায় তাঁরা কেনেন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পদও। টাকা ঢেলে এনু ২০১৮ সালে গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ পান। সেই সঙ্গে পরিবারের পাঁচ সদস্যসহ স্বজন-ঘনিষ্ঠজনদের টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগে ১৭টি পদ পাইয়ে দেন তাঁরা। এসব পদ-পদবির জোরে নির্বিঘ্নে চলছিল তাঁদের ক্যাসিনো কারবার।
সিআইডি জানায়, অবৈধ টাকায় তাঁরা স্বর্ণালংকার কিনে বাসার সিন্ধুকসহ স্বজনদের কাছেও গচ্ছিত রাখতেন। গত সেপ্টেম্বরে বাড়িতে চালানো অভিযানে র্যাব তাঁদের মালিকানার পাঁচ কোটি টাকা ও ৭২০ ভরি স্বর্ণালংকার জব্দ করেছিল।
সিআইডি সূত্র জানায়, গতকাল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দুই ভাই জানিয়েছেন, দেশ থেকে পালানোর জন্য তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে বহু কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে ধরনা দিয়েছেন ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের কাছে। জাল পাসপোর্ট তৈরি করেছেন। সীমান্তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছেন। গতকাল ধরা পড়ার পরও তাঁরা সিআইডিকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ফারুক হোসেন বলেন, সোমবার সকালে ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জে চালানো পৃথক অভিযানে ক্যাসিনো মামলায় পলাতক দুই আসামি, গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা দুই ভাই এনামুল হক এনু ও রূপন ভূঁইয়া গ্রেপ্তার হয়েছেন। ক্যাসিনো কারবারসহ মানি লন্ডারিং আইনে তাঁদের বিরুদ্ধে চারটি মামলার তদন্ত চলছে। ওই সব মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় দুই ভাইয়ের কাছে থাকা বিপুল পরিমাণ অর্থও উদ্ধার করা হয়েছে। সিআইডি সূত্র জানায়, দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে অবৈধ ক্যাসিনো কারবারে ২১ কোটি ৮৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলা রয়েছে।
এনু ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের শেয়ারহোল্ডার। তিনি গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। তাঁর ভাই রূপন ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
যেভাবে গ্রেপ্তার :
এক ব্রিফিংয়ে সিআইডির ‘অর্গানাইজড ক্রাইম’ বিভাগের ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, কেরানীগঞ্জে এক ঘনিষ্ঠের বাড়িতে দুই ভাই দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। এর আগেও ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তখন তাঁরা ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানে থেকে তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল স্পিডবোটে করে অবৈধভাবে মিয়ানমার হয়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানো। ব্যর্থ হয়ে তাঁরা নেপাল হয়ে ভারতে পালানোর পরিকল্পনা করেন। সেই প্রস্তুতির মধ্যেই অতি সম্প্রতি তাঁরা কেরানীগঞ্জে মোস্তফা নামের এক সহযোগীর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা অন্য নামে পাসপোর্ট তৈরি করেন। তাঁরা নেপাল হয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য ৪০ লাখ টাকা সঙ্গে রেখেছিলেন। ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ১২টি মোবাইল ফোনও সঙ্গে রাখেন। এ সবই জব্দ করেছে সিআইডি।
এলাকায় স্বস্তি :
গতকাল বিকেলে দয়াগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এনু-রূপনের গ্রেপ্তারের খবরে সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করছে। এক বাসিন্দা জানান, তাঁদের ভয়ে এলাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না। দুই ভাই যখন গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করতেন তখন মনে হতো তাঁরা এ এলাকার জমিদার। তাঁদের গাড়িবহর যাওয়ার সময় লোকজন ভয়ে রাস্তা ছেড়ে দিত। এলাকায় জুয়া, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে তাঁরা জড়িত রয়েছেন।
স্থানীয়রা জানায়, দয়াগঞ্জের আওয়ামী লীগ অফিসে মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে আসতেন এনু ও রূপন। তাঁদের সঙ্গে ২০-২৫ জন থাকত। তাদের অনেকের কাছে থাকত আগ্নেয়াস্ত্র। এলাকার পুরনো নেতাদের তাঁরা সম্মান করার দরকারই মনে করতেন না।
খালেদের ডান হাত দুই ভাই :
স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, ২০১৬ সালের আগে এনু ও রূপনকে চিনতেন না তাঁরা। ওই বছর তাঁরা জানতে পারেন, এনু ও রূপন গেণ্ডারিয়া থানা কমিটিতে নেতা হিসেবে স্থান পেয়েছেন। এক যুবলীগ নেতা জানান, ওই সময় এনু ও রূপনকে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের (র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার) সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখেন। এর কিছুদিন পরই তাঁরা এলাকায় চাঁদাবাজি শুরু করেন। যুক্ত হন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো কারবারে। এরপর তাঁদের ভাই ও ভাতিজাদের মধ্যে ১৪ জন জড়িয়ে পড়ে ক্যাসিনো কারবার ও চাঁদাবাজিতে। প্রতিদিন তাঁরা লাখ লাখ টাকা কামাতে শুরু করেন। এভাবে তিন বছরে শতাধিক কোটি টাকার মালিক হন। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা পুরান ঢাকার তিনটি বাড়িতে বসবাস করে। অন্য বাড়িগুলো ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এই দুই ভাইয়ের বাবার নাম সিরাজ মিয়া। তিনি দুই বিয়ে করেন। দুই স্ত্রীর ঘরে জন্ম হয় ছয় সন্তানের। বড় স্ত্রীর ঘরে জন্ম হয় এনু, রূপনসহ পাঁচ ভাইয়ের। তাঁদের বড় ভাই রশীদুল হক ভূঁইয়া বর্তমানে ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাঁর হাত ধরেই এনু ও রূপন রাজনীতিতে নামেন। তবে একটি সূত্রের দাবি, তাঁরা একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, এনু-রূপনরা ওয়ারীর মুসন্দি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের বাবার একটি টিনশেড বাড়ি ছিল।
আগের অভিযান :
গত ২৪ সেপ্টেম্বর সকালে প্রথমে র্যাব-৩-এর একটি দল সূত্রাপুর থানাধীন কাঠেরপুল লেনের ৩১ নম্বরের ছয়তলা বাড়িতে অভিযান চালায়। এটি এনু ও রূপনদের মূল বাড়ি। ভবনটির তিনতলায় ও পাঁচতলার ফ্ল্যাটের ভল্টের ভেতর থেকে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা, আট কেজি স্বর্ণালংকার ও পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। পরে র্যাব খবর পায়, তাঁদের আরো টাকা ও অস্ত্র আছে নারিন্দার দুটি বাড়িতে। এরপর ৮২/১ নারিন্দা লালমোহন স্ট্রিটে এনুর কর্মচারী আবুল কালাম ওরফে কালার ফ্ল্যাট থেকে দুই কোটি টাকা ও একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। ওই দিনই বিকেলে শরত্গুপ্ত রোডের ২১/১/এ নম্বর দোতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় অভিযান চালিয়ে একটি লকার থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। এ বাড়ির মালিক হারুনুর রশীদ। তিনি এনুর বন্ধু বলে জানিয়েছেন হারুনের স্ত্রী নাদিয়া শারমিন লিপি।
বাড়িতে ছিল ৬৯৭ কেজি ওজনের ভল্ট :
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধভাবে কামানো বিপুল টাকা ব্যাংকে না রেখে নিজেদের কাছে রাখার জন্য তাঁরা ৬৯৭ কেজি ওজনের একটি ভল্ট বানিয়েছিলেন। সেটি দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট এবং প্রস্থে তিন ফুট। এ ছাড়া আরো চারটি ভল্ট বানান। বড় ভল্টটি ১০-১৫ জন লোকের চেষ্টায় তাঁদের বানিয়ানগরের বাসায় উঠানো নয়। তখন তাঁদের বিপুল নগদ অর্থ থাকার খবরও ছড়িয়ে পড়তে থাকে।